Blog Archive

Wednesday, February 18, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৭৮

[পূর্বকথা দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে রাজারাকেউই লক্ষ্যভেদে সক্ষম হল না...রাজারা ক্রুদ্ধ হল...শ্রীকৃষ্ণ বলরামকে বলেন এক মাত্র অর্জুনই এ লক্ষ্য ভেদ করবেন...] 

সকলকে লক্ষ্য বিন্ধনে ধৃষ্টদ্যুম্নের অনুমতিঃ 
 

দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে ভাই ধৃষ্টদ্যুম্ন ক্ষত্রিয়দের বারবার লক্ষ্যভেদের জন্য অনুরোধ জানাতে লাগলেন। 
তাঁর এই পুনঃপুনঃ অনুরোধ শুনে কুরুবংশপতি মহামতি ভীষ্ম উঠে এলেন। ধনুকের কাছে গিয়ে তাকে টেনে তুললেন। বাম হাঁটু ভেঙে বসে মহাধনু নত করে গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম মহা টঙ্কার দিলেন। সেই মহাশব্দে সকলে মোহিত হলেন। 

গঙ্গাপুত্র উচ্চস্বরে বলেন–শুনুন পাঞ্চাল নরেশ ও অন্যান্য রাজনগণ। সবাই জানেন আমি স্ত্রী গ্রহণ করব না। লক্ষ্যভেদ করে আমি কন্যাকে দুর্যোধনের হাতে তুলে দেব। 
এত বলে ভীষ্ম ধনুকে বাণ জুড়লেন। ঠিক সে সময় তিনি শিখন্ডীকে দেখলেন। ভীষ্ম প্রতিজ্ঞা করেছিলেন অমঙ্গল দেখলে ধনুঃশর ত্যাগ করবেন। শিখন্ডী দ্রুপদরাজার পুত্র তবে নপুংসক। তাকে দেখেই ভীষ্ম ধনুক রেখে দিলেন। 

ভীষ্মকে ধনু ত্যাগ করতে দেখে ধৃষ্টদ্যুম্ন দুঃখিত হয়ে পুনরায় সকল জাতির মানুষকে লক্ষ্যভেদে আহ্বান জানালেন - ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র-যে কেউ লক্ষ্যভেদে সক্ষম হবেন কৃষ্ণা তাঁরই হবেন। 

এত শুনে দ্রোণ উঠে এলেন। মাথায় তাঁর শুভ্র উষ্ণীষ(পাগড়ি), শুভ্র মলয়জে(চন্দনে) শুভ্র অঙ্গ, হাতে ধনুর্বাণ, পিঠে নিষঙ্গ(বাণ রাখার স্থান)। 

ধনুক হাতে নিয়ে দ্রোণ বলেন–আমি যদি লক্ষ্যভেদে সক্ষম হই তবু দ্রুপদকন্যা আমার জন্য নয়, সে আমার বন্ধুর কন্যা আমারও কন্যা সমান। আমিও কন্যাকে দুর্যোধনের হাতে তুলে দেব। 
এত বলে বাম হাতে তিনি ধনুক তুলে টঙ্কারের সাথে গুণ পরালেন। তাঁর অবলীলায় এ কর্ম দেখে মনে হল তিনি সহজেই লক্ষ্যভেদ করবেন। লক্ষ্য দেখতে তিনি জলের ছায়ার দিকে দেখলেন। বুঝলেন দ্রুপদ অপূর্ব লক্ষ্য রচনা করেছেন। পঞ্চক্রোশ উঁচুতে সোনার মৎস আছে। তাঁর অর্ধেক পথে রাধাচক্র ঘুরছে। অদ্ভুত তৈরী চক্রটি দ্রুত ঘুরে যাচ্ছে। তাঁর মাঝে একটি ছিদ্র আছে যার মধ্যে দিয়ে কেবল একটি বাণই যেতে পারে। মাথা উঠিয়ে মাছটিকে একবার দেখতে চাইলে তাকে দেখা যায় না। কিন্তু জলের ছায়ায় ছিদ্রপথে মৎস দেখা যাচ্ছে। নিচের দিকে মুখ করে মাছের ছায়া দেখে লক্ষ্যস্থির করে উপর দিকে বাণ চালিয়ে লক্ষ্যভেদ করতে হবে। দ্রোণ ধনুক টেনে জলের ছায়া দেখতে থাকেন। 
 
তা দেখে যদুরায়(কৃষ্ণ) চিন্তিত হলেন। তিনি ভাবেন –দ্রোণ পরশুরামের শিষ্য। নানা বিদ্যা অস্ত্রশস্ত্রে তিনি পারদর্শি। বিশেষ করে ধনুর্বেদে তিনি সবার গুরু ও সকল সৃষ্টিভেদে পারঙ্গম। এই লক্ষ্যভেদও তাঁর পক্ষে অসম্ভব নয়, এক্ষুনি তিনি হয়ত তা ভেদ করলেন। এই ভেবে তিনি তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে রাধাচক্রকে আবৃত করলেন। মৎসলক্ষ্য ঢাকা পরে সেই সুদর্শন চক্রে। এদিকে দ্রোণাচার্য বাণ আকর্ণ টেনে ধরলেন এবং জলের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্যস্থির করে বাণ ছারলেন। মহাশব্দে বাণ আকাশের দিকে ধাবিত হল। কিন্তু সুদর্শনচক্র স্পর্ষ করে মাটিতে এসে পরে গেল। লজ্জিত হয়ে দ্রোণ ধনুক রেখে সভায় অধোমুখে এসে বসলেন। 

পিতার লজ্জা দেখে দ্রোণি অশ্বত্থামা রাগে ফেটে পরলেন। তিনি এসে বাহাতে ধনুক উঠালেন। ধনুকে টঙ্কার দিয়ে জলের দিকে দেখে চক্র ছিদ্রপথের উদ্দেশ্যে বাণ ছুড়লেন। উল্কার মত বাণ গর্জিয়ে ছুটল কিন্তু রাধাচক্রে ঠেকে খানখান হয়ে গেল। 

দ্রোণ ও দ্রোণিকে এভাবে বিফল হতে দেখে বিষম লজ্জার ভয়ে আর কেউ উঠে এলেন না। 
তখন সূর্যের পুত্র মহাবীর কর্ণ ধনুকের দিকে দ্রুত এগিয়ে গেলেন। পায়ে ভর দিয়ে বাম হাতে অনায়াসে ধনুক তুলে নিলেন। গুণ খসিয়ে পুনরায় গুণ পরালেন। ধনুক টঙ্কার দিয়ে বাণ জুড়লেন বীর কর্ণ। ঊর্দ্ধবাহু অধোমুখে লক্ষ্য স্থির করলেন ও বাণ ছুড়লেন। বাণ বায়ুর সমান বেগে ছুটল, জ্বলন্ত আগুন যেন অন্তরীক্ষে উঠল। কিন্তু সুদর্শনচক্রে ঠেকে বাণ চূর্ণ হয়ে গেল এবং খন্ড খন্ড হয়ে মাটিতে পরল। 
লজ্জা পেয়ে কর্ণ ধনুক মাটিতে ফেলে অধোমুখে সভায় গিয়ে বসে পরলেন। ভয়ে কেউ আর ধনুকের দিকে চেয়ে দেখে না। 

ধৃষ্টদ্যুম্ন আবার সবাইকে আহ্বান জানাতে থাকেন - ব্রাহ্মণ হোক, ক্ষত্রিয় হোক, বৈশ্য অথবা শূদ্র, এমন কি চন্ডাল বা যে কেউ লক্ষ্য ভেদ করুন, দ্রৌপদীকে সেই পাবে। 

এত অনুরোধ সত্ত্বেও কেউ ধনুকের কাছে যায় না। এভাবে একুশতম দিন কাটতে লাগল। 
এদিকে ব্রাহ্মণদের মধ্যে বসে যুধিষ্ঠির, চারভাই তাকে ঘিরে আছেন। দেখে মনে হয় দেবতাদের মাঝে যেন আখন্ডল(দেবরাজ ইন্দ্র) বসে আছেন। তাদের কাছেও এসে ধৃষ্টদ্যুম্ন তাদের লক্ষ্যভেদে আহ্বান জানালেন - যে লক্ষ্যভেদ করতে পারবেন এই সুন্দরী দ্রৌপদী তাঁর। 
একথায় ধনঞ্জয় অর্জুনের মন চঞ্চল হল। লক্ষ্যভেদে তাঁর ইচ্ছে হতে যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকালেন। 
অর্জুনের মনের ইচ্ছে বুঝতে পেরে যুধিষ্ঠির তাকে সম্মতি জানালেন। 
আজ্ঞা পেয়ে অর্জুন দ্রুত উঠে ধনুকের কাছে এগিয়ে যান। দেখে অন্য ব্রাহ্মণরা তাকে জিজ্ঞেস করেন –কোথায় যাচ্ছ তুমি, কি প্রয়োজনে সভার মাঝে উঠে যাচ্ছ! 

অর্জুন বলেন -আমি লক্ষ্যভেদ করতে যাচ্ছি। আপনারা আমায় আজ্ঞা দিন। 

শুনে ব্রাহ্মণরা হাসে। -কন্যাকে দেখে যে এ বামুনের মাথা খারাপ হল দেখছি! যে ধনুকে সকল রাজা পরাজিত-জরাসন্ধ, শল্য, শাল্ব, কর্ণ, দুর্যোধন! সেই লক্ষ্যভেদ করতে চায় এক সামান্য ব্রাহ্মণ কোন লজ্জায়! ক্ষত্রিয় সমাজে এ ব্রাহ্মণদের হাসাবে। সব ক্ষত্র বলবে ব্রাহ্মণ-দ্বিজরা লোভী। এমন বিপরীত আশা করা উচিত নয়। বহুদুর থেকে সব ব্রাহ্মণরা এসেছেন বহু ধনের আশায়। এই এক কর্মে সে সব নষ্ট হবে। অসম্ভব আশা কেন কর! এস অনর্থ না করে এখানে এসে বস। 
এসব বলে ব্রাহ্মণরা তাকে ধরে বসিয়ে দিল। 

কিন্তু দ্রুপদ রাজপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নকে বারংবার এসে অনুরোধ করতে দেখে অর্জুন আবার অস্থির হলেন। 
পুনরায় তিনি ওঠার ইচ্ছা প্রকাশ করতেই শ্রীপতি(কৃষ্ণ) শঙ্খনাদ দিলেন। পাঞ্চজন্য শঙ্খনাদে(পঞ্চজন নামের দৈত্যের অস্থি দিয়ে তৈরী) তিনলোক পূর্ণ হল। দুষ্ট রাজারা সেই শব্দে স্তব্ধ হয়ে গেল। শঙ্খধ্বনি শুনে অর্জুন আনন্দিত হলেন। ভয়াতুর জনও আশ্বাস পেল। অর্জুনের মনে হল শঙ্খধ্বনি দিয়ে যেন তাকে আহ্বান জানান হল লক্ষ্যভেদ করে দ্রৌপদীকে গ্রহণ করার জন্য। গোবিন্দের(কৃষ্ণের) ইঙ্গিতে অর্জুন উঠলেন। পুনরায় ব্রাহ্মণরা তাকে ধরতে গেল। তারা বলে –ব্রাহ্মণ হয়েও তুমি ক্ষেপে উঠলে! তোমার এই কাজের ফলে সমগ্র ব্রাহ্মণকুল বিপদে পরবে। আমাদের দেখে দুষ্ট 
ক্ষত্রিয়রা হাসবে। সবাই আমাদের লোভী ভাববে। শেষে সভা থেকে হয়ত আমাদের তাড়িয়েই দেবে। যা পাওয়া গেছে এতদিনে তাও সব কেড়ে নেবে। এসব বলে সকলে জোড় করে আবার অর্জুনকে বসিয়ে দিল। 

তা দেখে যুধিষ্ঠির এগিয়ে এসে ব্রাহ্মণদের বোঝাতে লাগলেন –কেন ওনাকে বাঁধা দিচ্ছেন। কার কত ক্ষমতা সে নিজে তা জানে। যে লক্ষ্যভেদে রাজারা পিছু হটল শক্তি না থাকলে কে সে দিকে যাবে। যদি লক্ষ্যভেদ না পারে তবে নিজেই লজ্জা পাবে। আমাদের কাউকে বাঁধা দেওয়া উচিত নয়। 

যুধিষ্ঠিরের বাক্য শুনে সকলে অর্জুনকে ছেড়ে দিল। 
ধনুকের কাছে অর্জুন এগিয়ে গেলে ক্ষত্রিয়রা হেসে তাকে উপহাস করে বলে –ব্রাহ্মণের দেখি অসম্ভব কাজের ইচ্ছে হয়েছে। সভার মাঝে ব্রাহ্মণের কি লজ্জা নেই! যার কাছে রাজার সমাজ পরাজিত সেই সুরাসুর জয়ী বিপুল ধনুকে লক্ষ্যভেদ করতে চলেছে এই ভিক্ষুক! কন্যার রূপ দেখে ব্রাহ্মণের মাথা খারাপ হয়েছে। অনুমান করি ইনি একজন পাগল। কিংবা মনেমনে ভাবছে দেখি একবার। পারলে পারবো না হলে আমার কিবা যাবে। কিন্তু এই নির্লজ্জ্ব ব্রাহ্মণকে আমরা অল্পে ছাড়ব না। উচিত শাস্তি দেব। 
 
কেউবা বলে -ব্রাহ্মণদের ওভাবে বোলো না। ইনি হয়ত সামান্য মানুষ নন। দেখ ব্রাহ্মণের মনসিজের(কামদেবের) মত মূর্তি। পদ্মের মত দুই টানাটানা আঁখি কর্ণকে স্পর্ষ করে। সুন্দর অনুপম তনু তাতে শ্যাম নীলোৎপল আভা। মুখেও পবিত্র সুন্দর শোভা। সিংহগ্রীবা, লাল ঠোঁট, নাকটি এত সুন্দর যে খগরাজ(গড়ুর)ও লজ্জা পাবেন। সুচারু যুগ্ম ভুরু ললাটে বিস্তৃত। কি সানন্দ মন্দ মত্ত গতি! বাহু দুটি নাগকে নিন্দা করবে এত সুন্দর আজানুলম্বিত। বুকপাটা ও জানু দুটি বলশালী করিকরের(হাতির) মত। দন্তছটা যেন বিদ্যুৎকে জয় করেছে। এর রূপ দেখে যে কোন কামিনী ধৈর্য্যচ্যুত হবেন। ইনি মহাবীর্য্যবন্ত যেন সূর্য ও জলদে(মেঘে) আবৃত। অগ্নি কিরণ যেন ছাইয়ে আচ্ছাদিত। দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি ইনি লক্ষ্যভেদ করে দেবেন। 

কাশী বলেন কৃষ্ণের জনের কি কোন কর্ম হয় অসাধ্য! 
................................... 

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers