Blog Archive

Wednesday, February 25, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৮৩

[পূর্বকথা - দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে ভাই ধৃষ্টদ্যুম্ন ক্ষত্রিয়দের বারবার লক্ষ্যভেদের জন্য অনুরোধ জানাতে লাগলেন...শেষে অর্জুন যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞায় লক্ষ্য ভেদ করতে উঠলেন... তিনি গুরুজনদের প্রণাম জানালেন...কৃষ্ণ বলরামকে বলেন তিনি অর্জুনকে সর্বপ্রকার সাহায্য করবেন ...অর্জুন অনায়াসে লক্ষ্যভেদে সক্ষম হলেন ...অন্যান্য রাজা ক্রুদ্ধ হল... অর্জুনের সাথে তাদের যুদ্ধ শুরু হল .... ব্রাহ্মণদের সাথেও ক্ষত্রিয়দের যুদ্ধ শুরু হল...] 

কর্ণের সহিত অর্জুনের যুদ্ধঃ 

 

অর্জুন ও কর্ণের ভীষণ যুদ্ধ হল, দেখে শ্রীরাম ও রাবণের যুদ্ধের কথা মনে পরে। সে যুদ্ধ যেন বৃত্র ও বৃত্রহা(বৃত্র অসুর সংহারক=ইন্দ্র), মাধব(মা-লক্ষ্মী+ধব-স্বামী= নারায়ণ) ও উমাধব(উমা-দূর্গা+ধব-স্বামী=শিব) কিংবা গজেন্দ্র-কচ্ছপের যুদ্ধ। নানা অস্ত্রে দু’জনেই দুজনকে তাড়িয়ে বেরালো। 
দুর থেকে রাজারা দাড়িয়ে তা দেখতে থাকে। 
রেগে বীর ধনঞ্জয় অতুল প্রতাপে এক বাণে শত শত সাপ সৃজন করলেন। মহাশব্দে আকাশ জুড়ে সাপ ধেয়ে আসে, দেখে রাজারা ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়। হেসে কর্ণ গরুড় অস্ত্র ছাড়েন ফলে সুপর্ণ(গরুড়)এক গরাসে সব ভুজঙ্গ ধরে খায়। শত শত খগবর(গরুড়) আকাশে উড়ে ভুজঙ্গ খেয়ে পার্থকেও গিলতে আসে। পার্থও অগ্নি অস্ত্র মেরে সব পাখিদের পাখা পুড়ালেন। ঝাঁকে ঝাঁকে অগ্নিবৃষ্টি হতে থাকে কর্ণের উপর। দেখে কর্ণ জলধর অস্ত্রে বৃষ্টির মাধ্যমে বৈশ্বানর(অগ্নি) নির্বাপণ করে পার্থের উপরও মুষলধারায় জল বর্ষায়। ধনঞ্জয়ও সঙ্গে সঙ্গে দিব্যবাণ মারলেন। যা প্রচন্ড বায়ুর সৃষ্টি করে জলধর মেঘদের দুর করল। সেই সাথে মহাবাতে(বায়ু) রবির তনয় কর্ণও কেঁপে উঠল। সেও সঙ্গে সঙ্গে আকাশ অস্ত্রে বাত দুর করতে লাগল। এভাবে দুজনে দুজনকে নানা অস্ত্রাঘাত করতে থাকে- সূচীমুখ অর্দ্ধচন্দ্র পরশু(কুঠার), তোমর, জাঠা-জাঠি(পৌরাণিক লৌহযষ্ঠি যুদ্ধাস্ত্র), শক্তি শেল(শূল), মুষল মুদ্গর(গদা)। যার যত অস্ত্র জানা আছে শ্রাবণের বাধভাঙ্গা বর্ষার মত সব প্রয়োগ করতে থাকে। অস্ত্রের বর্ষণে সূর্যের তেজও ঢেকে গেল। দিনের দুই প্রহরেই অন্ধকার নেমে এল। 
আকাশে যত অমর দেবতারা তা দেখে প্রশংসা করতে থাকেন। মর্তের রাজারা এই যুদ্ধ দেখে বিস্মিত হয়। 

কর্ণও বিস্মিত হয়ে বলে –কহ বীর কেন তুমি ব্রাহ্মণের বেশ ধারণ করেছ। তুমি কি ছন্মবেশী সহস্রাক্ষ(ইন্দ্র), নাকি জগন্নাথ কিংবা বিরুপাক্ষ(বিরূপ অক্ষি যাঁর-শিব), নাকি ধনুর্বেদ, কিংবা রাম, নাকি তুমি জীবন্ত পান্ডবার্জুন। এতজন মধ্যে বল তুমি কোন জন। আমার সামনে অন্য কেউ এতক্ষণ প্রাণ নিয়ে দাড়াতে পারত না। 

এত শুনে ধনঞ্জয় হেসে বলেন –আমার তোমায় পরিচয় জানিয়ে কি হবে! আমার পরিচয় জেনে তোমারই বা কি কাজ! আমি দরিদ্র ব্রাহ্মণ, তুমি মহারাজ। আমায় একা পেয়ে তোমরা লাখ লাখ জন ঘিরে ফেললে, এখন হেরে, শক্তি হারিয়ে পরিচয় জানতে এসেছ। যদি প্রাণভয় পাও তো পালাতে পার। কাতরজনকে আমি আঘাত করি না। 

অর্জুনের একথায় আরুণি-কর্ণ রেগে গেল। অরুণ নয়ন, অরুণ অঙ্গজ বীর অরুণ প্রতাপে অরুণ সদৃশ বাণ আকর্ণ টেনে অর্জুনের উদ্দেশ্যে ছাড়ল। অর্ধপথে যদিও পার্থ তা ভেঙ্গে খান খান করলেন। এভাবে কর্ণ যত অস্ত্র ছোড়েন সব তা কেটে ফেলেন কিরীটী-অর্জুন। এবার চার বাণে অর্জুন কর্ণের রথের চার হয়(ঘোড়া) কাটলেন, সেই সাথে সারথিকেও। 
এভাবে যুদ্ধের মাঝে কর্ণকে বিরথী হতে দেখে রাজারা হাহাকার করতে থাকে। কর্ণকে রক্ষার জন্য সকলে অর্জুনকে ঘিরে ফেলে। অর্জুনও তাদের উপর অস্ত্র বর্ষণ শুরু করেন। বর্ষার ঘন মেঘে যেন পুনরায় বর্ষা শুরু হল। সূর্যের তেজ আবার ঢেকে গেল। সবার অঙ্গে পার্থ এত প্রহার করলেন যে সকলেই পরাস্থ হল। কারো কুন্ডলসহ মুন্ড কাটা গেল। কারো নাক কাটা গেল। কারোবা ধনুক হাতেই বাম হাত কাটা পরল। কেউবা বুকের আঘাতে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। ভাদ্র মাসের ঝড়ে যে ভাবে পাকা তাল পরে সে ভাবেই পার্থের আঘাতে রাজারা পরতে লাগল। পার্থ ভীষণ দর্শন পর্বতাকারে মুষলমুদ্গর মুন্ডে মারেন। নব মেঘ ঘট যেন ভূমিতলে শোভে। এভাবে পার্থের নির্ঘাতে সব গড়াগড়ি করে। লক্ষ লক্ষ তুরঙ্গ, সারথী, রথ, রথী, অর্বুদ অর্বুদ পাদাতিক সব পড়ে গেল। 
অনন্ত ফনীন্দ্র(নাগরাজ বাসুকি) যেমন সিন্ধুজল মন্থন করেন, তেমনি দুইভাই পার্থ ও ভীম মিলে রাজাদের বিনাশ করলেন। রক্তের নদী বয়ে গেল। চারদিকে হাহাকার পরে গেল। 
যে সব রাজারা প্রাণে বাঁচল তারা বিস্মিত হয়ে বুঝে গেল এই দুইজন সামান্য মানুষ নন। 

এভাবে রাজাদের নিবৃত্ত করে দুইভাই দুজনকে আনন্দে আলিঙ্গন করলেন। চারদিক থেকে দ্বিজ-ব্রাহ্মণরা এসে জয়ধ্বনি দিতে লাগল ও তাদের আশীর্বাদ করল। 
মহাভারতের কথা অমৃতের ধার, ইহলোক পরলোকের হিত ও উপকার। কাশীরাম দাস কহেন পাঁচালির ছন্দে, সজ্জন–রসিক-সাধুর জন্য মকরন্দে(পুষ্পমধু)। 
.............................. 

 
যুদ্ধে বিমুখ হইয়া রাজাদিগের পলায়নঃ 

চারদিকে দশ দশ যোজন(চার ক্রোশ পরিমাণ দৈর্ঘ্য) পথ রাজাদের দৌড় করান হল। আড়ে দীর্ঘে শত ক্রোশ রক্তে কাদা হল। 
রাজারা প্রথমে ‘দ্বিজ মার’ রব তোলে। সেই ভয়ে ব্রাহ্মণরা উর্দ্ধশ্বাসে পালায়। দন্ড, কমন্ডলু পড়ে থাকে। কারো চর্ম পাদুকা খুলে যায়, কাঁধ থেকে ছাতা পরে যায়। কারো মৃগচর্ম খুলে পরে, কারো বা পৈতে ছিঁড়ে যায়। পিছনে না চেয়ে বায়ুবেগে লক্ষ লক্ষ ব্রাহ্মণ প্রথমে পালাল। 
তারপর ক্ষত্রিয়ের সাথে ব্রাহ্মণের আবার সাঙ্গাতিক যুদ্ধ হল। সেই যুদ্ধে রাজাদের বর্ণনাতিত অপমান হল। কোথায় রথ, কোথায় গজ, কোথায় গেল ভৃত্যগণ! যেদিকে প্রাণ নিয়ে পালান যায় রাজারা পালাল। পশ্চিম দিকের রাজারা পূর্ব দিকে পালাল, উত্তরের রাজা দক্ষিণে গেল। 
পথাপথ জ্ঞান নেই, হুড়াহুড়ি, ঠেলাঠেলি, একজনকে চাপা দিয়ে বলবন্তজন আগে যেতে চায়। বলদ, উট, ঘোড়া, হাতি, সেনা, রথ, রথী, সারথী সকলে ভয়ে পালাল। রথের উপরের আরূঢজনের যে অবস্থা হল তা বলার নয়। চাপাচাপি ঠেলাঠেলিতে অর্ধেক সৈন্য মরল। স্থানে স্থানে স্তূপাকারে তারা পরে রইল। কারো এক পা কাটা গেল, কারো দুই হাত, বুকের আঘাতে কেউ বা কুঁজ হয়ে গেল। সর্বাঙ্গ দিয়ে রক্তেরধারা বইল। মুক্ত কেশ, ভগ্ন দেহ, কারো বা কান কাটা –সেই অবস্থায়ও কেউ কেউ প্রাণ নিয়ে পালাল, জলে পরে সাঁতরাতে থাকল। 

ক্ষত্র দেখে ব্রাহ্মণ পালায় উভরড়ে(দ্রুতবেগে)। দ্বিজ দেখে ক্ষত্রিয় লুকায় ঝাড়ে ঝোড়ে। এভাবে দ্বিজের ক্ষত্রিয় ভয়, ক্ষত্রের দ্বিজ ভয় হল। দ্বিজ ক্ষত্র বেশ ধরে, ক্ষত্র হয় দ্বিজ। ক্ষত্রিয়েরা ধনুর্বাণ, গদাশূল সব ফেলে, মাথার মুকুট খুলে চুল মুক্ত করল। হাতে তুলে নিল ছাতা, দন্ড ও কমন্ডল। ব্রাহ্মণরা হাতে ধনুর্বাণ তুলে নিল। প্রাণ ভয়ে কেউ জলে ডুব দিয়ে বসে থাকে, কেউ বা কাঁটাবনে, কেউ বা বৃক্ষের ডালে উঠে বসল। মড়ার ভিতর কেউবা মরা সেজে পরে রইল। দুরদুরান্ত পর্যন্ত কেউ ভয়ে স্থির হয়ে থাকতে পারল না। রাজ্যেও ভাঙচুর হল। ঘর, দেউল, প্রাচীর, বৃক্ষলতা, প্রাসাদ, মন্দির চূর্ণ হল। পাঞ্চাল রাজ্যের বৃক্ষ ঘর বাড়ি সব নষ্ট হল। রক্ষা পেল কেবল দ্রুপদ নগর। 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীদাস কহে সাধুজন করেন পান। 
................................... 

Tuesday, February 24, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৮২

[পূর্বকথা - দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে ভাই ধৃষ্টদ্যুম্ন ক্ষত্রিয়দের বারবার লক্ষ্যভেদের জন্য অনুরোধ জানাতে লাগলেন...শেষে অর্জুন যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞায় লক্ষ্য ভেদ করতে উঠলেন... তিনি গুরুজনদের প্রণাম জানালেন...কৃষ্ণ বলরামকে বলেন তিনি অর্জুনকে সর্বপ্রকার সাহায্য করবেন ...অর্জুন অনায়াসে লক্ষ্যভেদে সক্ষম হলেন ...অন্যান্য রাজা ক্রুদ্ধ হল... অর্জুনের সাথে তাদের যুদ্ধ শুরু হল

দ্বিজগণের সহিত ক্ষত্রগণের যুদ্ধঃ 
 
প্রলয়কালে যেমন সাগর উথলে ওঠে, তেমনি রাজারা ‘মার, মার’ শব্দে ধেয়ে এলো। চারদিকে সবার মুখে একই রব-দুষ্টমতি দ্বিজ ব্রাহ্মণদের আজ মেরে ফেলতে হবে। 
সেই সিংহনাদে ব্রাহ্মণরা প্রমাদ গণল। যুধিষ্ঠিরকে ডেকে তারা বলে –দেখ মনে হচ্ছে যেন শেষকাল উপস্থিত। বাঁধভাঙ্গা সমুদ্র যেন উথলাচ্ছে। চল সকল ব্রাহ্মণ-আমরা দ্রুত এখান থেকে চলে যাই। মরতে এই ব্রাহ্মণদের আমরা সঙ্গে আনলাম। নিজে তো মরবেই সঙ্গে অন্য দ্বিজ-ব্রাহ্মণদেরও দুঃখ দেবে। ক্ষত্রিয় রাজাদের সঙ্গে মিছে বিবাদ ঘটাল। দক্ষিণার অভিপ্রায় ত্যাগ করে এখন প্রাণ নিয়ে পালাতে পারলে হয়। এখানে থাকলে মরতে হবে। ক্ষত্রিয়ের কাজ কখনও ব্রাক্ষণকে সাজে না। রাজকন্যা দেখে লোভে লক্ষ্যভেদ করে বসল। যাক্‌ সে সব কথা বলে আর লাভ নেই। দেখ ক্ষত্রিয়রা ‘দ্বিজ মার’ রব তুলে এগিয়ে আসছে। 
পালাও, পালাও বলে সব ব্রাহ্মণরা ডাকতে লাগল। 

মুনিরাও ঊর্দ্ধমুখে পালাল। বিশসহস্র শিষ্য নিয়ে মার্কন্ড মুনি, পঞ্চাশজন শিষ্য নিয়ে কৌন্ডমুনি পালালেন। বাইশসহস্র শিষ্য নিয়ে ব্যাস পালালেন। পুলস্ত্যমুনিও পিছু নিলেন। ষাটশত শিষ্য নিয়ে পালালেন দুর্বাসা। পচিশসহস্র নিয়ে পরাশরমুনিও স্থান ত্যাগ করলেন। 
চারদিকে দৌড়াদৌড়ি শুরু হল। সব দেখে দ্বন্দ্ব প্রিয় ঋষি আনন্দিত হয়ে উল্লাসে করতালি দিয়ে নাচেন। ‘লাগ, লাগ’ বলে ডাক ছাড়ে আর ক্ষণে ক্ষণে রাজাদের গালি দিতে থাকে -ক্ষত্রকুলে তোমাদের জন্ম ব্যর্থ হল। একজন বামুন সকলকে পরাজিত করল। কন্যা নিয়ে সে যদি এই সভা ছেড়ে যায় তবে কোন লজ্জায় তোমরা মুখ দেখাবে! 
এই বলে ঊর্দ্ধবাহু নাচে ঋষিবর। 
তা শুনে রাজারা ক্ষিপ্ত হয়ে ব্রাহ্মণদের সাথে তুমুল যুদ্ধ শুরু করল। যদিও সকল ক্ষত্রের অস্ত্র ইন্দ্রপুত্র অর্জুন সহজেই কাটলেন। নিজের অস্ত্রে রাজাদের প্রহার করতে লাগলেন। কারো ধনুক কাটা গেল, কারোবা গুণ, কারো কাটে খড়্গ, তো কারো তূণ। কেউ সারথি হারায়, কেউ বা রথ, কারোবা শর, শেল, শূল, শক্তি সব নষ্ট হল। শেষ পর্যন্ত সকল রাজা নিরস্ত্র হল। দশ দশ বাণে সবাইকে বিদ্ধ করলেন অর্জুন। মুখে, বাহুতে, পায়ে বাণ খেয়ে কেউ মূর্ছা গেল, কেউ বা গড়াগড়ি খেতে লাগল। সকল সারথিরা ভয়ে রথের মুখ ঘুরিয়ে নিল। চারদিকে রাজারা যুদ্ধ ভঙ্গ দিয়ে পালাতে শুরু করল। 
পেছন ফিরে পার্থ কৃষ্ণাকে আশ্বাস দিতে থাকেন। 

তাই দেখে বীর কর্ণ খলখল করে হেসে বলে –কি কাজ করছ দ্বিজ, তোমার কি লজ্জা নেই! সভার মাঝে পরের নারীর সাথে সম্ভাষণ করছ! আগে কৃষ্ণাকে নিজের স্ত্রী কর, তারপর তাঁর সাথে কথা বলতে এসো। ভিক্ষুক হয়ে এ অদ্ভূত ইচ্ছা কি ভাবে হল যে রাজার কন্যাকে কামনা কর। 

পার্থ ঘুরে রাধার পুত্রকে বলেন –কর্ণ তুমি এখনও জীবিত! ওরে দুরাচার, ধন্য তোর প্রাণ! আমার বাণ খেয়েও বেঁচে আছিস। 

কর্ণ বলে -দ্বিজ বুঝে ভাষা প্রয়োগ কর। তুমি কোন দেশ থেকে এসেছ জানি না। ব্রাহ্মণ বলেই তোমায় অনুরোধ করলাম। আমি রেগে গেলে কারো প্রাণে বাঁচা সম্ভব নয়। 

কর্ণের কথা শুনে পার্থ বলেন –আমি দ্বিজ একথা কে বলেছে। যুদ্ধ ভয় আছে বলেই তুমি এ অযুহাত দিচ্ছ। দুর্যোধনের ভাঁড়, তুমি বৃথা রাজ্য ভোগ কর। শাস্ত্রমতে ক্ষত্রনীতিতে বলে তাঁর সাথে যুদ্ধ করতে নেই যে রণে ভীত। আর সেখানেই বলেছে যুদ্ধে ব্রাহ্মণ গুরু একই সমান। তুমি দেখছি বড়ই ধার্মিক ও ব্রহ্মবধে ভীত। তাই একজনকে ঘিরে ধরেছিলে সকলে মিলে। এখন বল হারিয়ে অনুরোধ করতে এসেছ। কে তোমায় ক্রোধ শান্ত করতে বলেছে! যত শক্তি আছে প্রয়োগ কর, আমাকে ব্রাহ্মণ ভেবে ক্ষমা করতে চেয়ো না। 

অর্জুনের কথায় কর্ণ রাগে জ্বলতে থাকে। নানা ধরনের অস্ত্র বীর পার্থের উপর বর্ষণ করতে থাকে। এভাবে কর্ণ ও ধনঞ্জয়ের সাঙ্ঘাতিক যুদ্ধ শুরু হল। 
বীর বৃকোদর ভীমও বৃক্ষ হাতে আসরে নেমে পরলেন। মার মার রবে চারদিকে অস্ত্র কাটতে থাকেন। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে যেমন মেঘ ফেটে বৃষ্টি হয় তেমনি অস্ত্রবর্ষণ হতে থাকে। মুষল-মুদ্গর-শেল-শূল-শক্তি-জাঠ-গদা-চক্র-পরশু-ভুশুন্ডি কোটি কোটি পরতে লাগল। চতুর্দিকে মার মার রব ওঠে, ঝাঁকে ঝাঁকে বৃষ্টির মত অস্ত্র ফেলতে থাকে। বীর বৃকোদর শরজালে ঢেকে গেলেন। কুয়াসা যেমন ভাবে পর্বতকে আচ্ছাদিত করে। 
বায়ুনন্দন ভীমের বায়ু পরাক্রম। এমন অজাযুদ্ধ(যাতে প্রকৃত যুদ্ধ অপেক্ষা আস্ফালনই বেশি) দেখে তিনি বাঘের মত ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি প্রকৃত সংগ্রামে আনন্দ পান তাই এসব অস্ত্র প্রহারে একটুও তার শ্রম হল না। সংগ্রাম, আহার ও রমণী-রমণে তিনি সহজে ঠাঁই নারা হন না। ঘি পরলে যেমন আগুনে তেজ বাড়ে তেমনি যত অস্ত্র পড়তে থাকে ভীমের ক্রোধ ততই উথলে ওঠে। জন্তুদের সামনে তিনি কালরূপে উপস্থিত হলেন। গর্জন করতে করতে বৃক্ষ ঘুরিয়ে তিনি সব অস্ত্র নিবারণ করে বৃক্ষ দিয়ে আথালিপাথালি মারতে থাকেন। রথ, রথী, অশ্ব, হাতি, ধ্বজ সব চূর্ণ হতে থাকে। ডানে-বামে-আগে-পিছের বহু সৈন্য তাঁর গাছে নিপাতিল। তারপর মুখ তুলে বৃকোদর যেদিকে চান সেদিকের সৈন্য প্রাণ ভয়ে পালায়। সিন্ধুজলের মাঝে যেন তিনি মন্দর পর্বত। মত্ত হস্তিবর যেন পদ্মবন ভাঙ্গে। মৃগেন্দ্র(সিংহ) বিহার করছেন যেন গজেন্দ্রমন্ডলে। দানবের মধ্যে যেন দেব আখন্ডল(ইন্দ্র)। দন্ড হাতে যম, যেন বজ্র হাতে ইন্দ্র। সব রাজাদের তিনি তাড়িয়ে নিয়ে যান। বাঘ যেন ছাগলের পালকে খেদিয়ে নিয়ে যায়। সকল রাজা ভয়ে পালাল। 
বিংশ অক্ষৌহিনীপতি(১০৯৩৫০পদাতিক, ৬৫৬১০অশ্ব, ২১৮৭০হস্তী, ২১৮৭০রথ- মোট ২১৮৭০০ চতুরঙ্গ সেনাবিশিষ্ট বাহিনী) জরাসন্ধ পালাল, একাদশ অক্ষৌহিনীপতি দুর্যোধন, সপ্ত অক্ষৌহিনীপতি বিরাটরাজা, পঞ্চ অক্ষৌহিনীপতি শিশুপাল, নব অক্ষৌহিনীপতি কলিঙ্গরাজ, বিন্দ-অনুবিন্দ চার অক্ষৌহিনীপতি সবাই পালাল। কোথায় গেল রথ, গজ, তুরঙ্গ, পদাতি-সকলে যে যার প্রাণ নিয়ে একাই পালাতে লাগল। ‘আসছে, আসছে’ বলে সকলে পিছনে আর না তাকিয়ে দৌড়ায়। মাথা থেকে মুকুট, হাত থেকে ধনুক খসে পরে। কেউ আর সাহস করে সে সব তুলতে যায় না। উর্দ্ধশ্বাসে সব পালায় আর পিছনে ভীমসেন ‘মার, মার’ বলে ডাক দেন। 

 
সব দেখে মদ্ররাজ গর্জে ওঠে। নানা অস্ত্রে ভীমকে প্রহার করতে থাকে। রেগে ভীম বৃক্ষ দিয়ে প্রহার করে তাঁর রথ চূর্ণ করেন। লাফ দিয়ে শল্য মাটিতে পরে। হয়(ঘোড়া), রথ চূর্ণ হতে গদা হাতে শল্য ও বৃক্ষ হাতে ভীমের অসীম যুদ্ধ হল। সকলে লুকিয়ে লুকিয়ে কৌতুক দেখতে লাগল। গোল করে দু’জনে দুজনকে ঘুরতে থাকে। শেষে পর্বতের উপর যেন পর্বত পরল। সকলে অবাক হয়ে দেখতে লাগল। পর্বতে বজ্রাঘাত হলে যেমন শব্দ হয় তেমনি দুজনের শব্দে চারদিক পূর্ণ হল। মত্ত হাতির মত তারা লড়তে লাগল। মনে হল মত্ত ষাঁড় যেন প্রলয়ের মেঘের মত গর্জন করছে। তাদের ঘনঘন হুঙ্কারে সকলে কাঁপতে লাগল। তারা পরস্পরকে দেখে দাঁত কড়মড়ি করতে লাগল। তাদের চরণের দর্পে ভূমিকম্প হতে লাগল। এভাবে অনেক্ষণ যুদ্ধ হতে থাকল। শেষে ভীম রাগে ঠোঁট কামড়ে শল্যের হাতে বৃক্ষের প্রহার করলেন। গুরুতর আঘাতে গদা খসে পরল। নিরস্ত্র শল্যের আর কিছু রইল না। লাফ দিয়ে পবনকুমার ভীম তাকে ধরে ফেললেন। শল্যের পা ধরে তাকে শূন্যে ঘোরাতে লাগলেন। 
তা দেখে ব্রাহ্মণমন্ডলী হাসতে লাগল। তারা টিটকারি দিয়ে, করতালি দিয়ে নাচতে নাচতে বলে -আরে দুষ্ট ক্ষত্রগণ যে কাজ করলে তাঁর উচিত ফলও হাতেনাতে পেলে। তবে এই মদ্রপতি সর্বদা ব্রাহ্মণদের সেবা করেছে, সে কারণে একে মারা উচিত নয়। 
শল্য প্রায় জ্ঞান হারাতে বসেছিল। আর দু-তিন পাকে প্রাণ বেরিয়ে যেত। ভীম ব্রাহ্মণদের অনুরোধে এবং সম্পর্কে তাঁর মামা হওয়ায় শল্যকে ছেড়ে দিলেন। 
দেখে রাজারা অবাক হল। বাহুযুদ্ধে শল্যকে কেউ পরাজিত করতে পারত না-এক হলধর বলরাম এবং বীর বৃকোদর ভীম ছাড়া। 

মহাভারতের কথা সুধা সিন্ধুর মত, কাশীদাস কহেন সাধু শুনেন অবিরত। 
................................... 

Monday, February 23, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৮১

[পূর্বকথা - দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে ভাই ধৃষ্টদ্যুম্ন ক্ষত্রিয়দের বারবার লক্ষ্যভেদের জন্য অনুরোধ জানাতে লাগলেন...শেষে অর্জুন যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞায় লক্ষ্য ভেদ করতে উঠলেন... তিনি গুরুজনদের প্রণাম জানালেন...কৃষ্ণ বলরামকে বলেন তিনি অর্জুনকে সর্বপ্রকার সাহায্য করবেন ...অর্জুন অনায়াসে লক্ষ্যভেদে সক্ষম হলেন ...অন্যান্য রাজা ক্রুদ্ধ হল... ] 

অর্জ্জুনের সহিত রাজগণের যুদ্ধঃ 

 

ক্রুদ্ধ রাজারা অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হন-জরাসন্ধ, শল্য, শাল্ব, কর্ণ, দুর্য্যোধন, শিশুপাল, দন্তবক্র(শিশুপালের ভাই, কৃষ্ণের শত্রু), কাশীর রাজা, রুক্মী, ভগদত্ত, ভোজ, কলিঙ্গ প্রভৃতি। চিত্রসেন, মদ্রসেন, চন্দ্রসেন, নীলধ্বজ, রোহিত, মহাতেজা বিরাট, কিচক(বিরাটের সেনাপতি), ত্রিগর্ত, সুবাহু রাজা প্রমুখ সকলে নানা অস্ত্রবর্ষণ শুরু করে। খট্টাঙ্গ(মুগুর বিশেষ), ত্রিশূল, জঠী, ভূষন্ডী, তোমর, শেল, শূল, চক্র, গদা, মুষল, মুদ্গর(গদা) প্রভৃতি অস্ত্র রাজারা প্রয়োগ করতে লাগলো। 

রাজাদের এমন রূপ দেখে দ্রৌপদীর হৃদয় কম্পিত হল, তিনি ভয়ে অর্জুনের দিকে তাকিয়ে বলেন –দ্বিজবর, এখন তো কোন উপায় দেখছি না। রাজারা সমুদ্রের মত আমাদের ঘিরে ফেলেছে। এদের বিরুদ্ধে আমার পিতার শক্তি খুবই সামান্য। আমি আপনাকে বরণ করে সকলকেই বিপদের ফেললাম। 

অর্জুন দ্রৌপদীকে অভয় দিয়ে বলেন –তুমি আমার কাছে থাক। আমার পিছনে নির্ভয়ে দাড়িয়ে দেখ আমি কি করি। 

কৃষ্ণা দ্রৌপদী অবাক হয়ে বলেন –একা আপনি কি করবেন এই লক্ষ রাজাদের বিরুদ্ধে! 

হেসে অর্জুন বলেন –হে গুণবতী, একাই আমি এই নরপতিদের বিনাশ করব। একার প্রতাপও কত শক্তিধারী তা তুমি দেখছি জাননা। একা সিংহ সকল শত্রুকে তাড়ায়, একেশ্বর গরুড় সকল পক্ষীকে নাশ করতে পারে, একেশ্বর পুরন্দর-ইন্দ্র সকল দানবকে বিনাশ করেন, একা বাঘ লক্ষ হরিণ নাশ করে, একা বিষধর শেষনাগ সমুদ্রমন্থন করলেন, একা হনুমান লঙ্কা জ্বালালেন-তেমনি আমিও এই রাজাদের নাশ করব, তুমি ভয় পেয় না। 

এভাবে অর্জুন দ্রৌপদী-কৃষ্ণাকে আশ্বাস দিলেন। অর্জুন ধনুরগুণে টঙ্কার দিলেন। দ্রুপদরাজা পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন ও শিখন্ডী এবং ভাই সত্যজিতকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন কিন্তু মুহুর্তে রাজাদের আক্রমণে সসৈন্য পলায়ন করলেন। অর্জুনকে সকলে ঘিরে ফেললো। 
দেখে পবনকুমার ভীম ঠোঁট কামড়ালেন। তিনি যুধিষ্ঠিরের সম্মতি চাইলেন। 
যুধিষ্ঠির সব দেখে সম্মত হয়ে বলেন –অনর্থ হল, একলক্ষ রাজা অর্জুনকে ঘিরে ধরেছে। শীঘ্র গিয়ে ভীম অর্জুনকে নিয়ে এস। যুদ্ধ করার কোন প্রয়োজন নেই। 

বড়ভাইয়ের অনুমতি পেয়ে বৃকোদর ভীম একটি দীর্ঘ বৃক্ষ উপড়িয়ে দৌড়ে গেলেন। অতি উঁচু বৃক্ষটিকে নিষ্পত্র করলেন। বায়ুবেগে ধেয়ে ভীম সৈন্যদের মধ্যে প্রবেশ করলেন। ব্রাহ্মণরাও ক্ষত্রিয়দের এমন আক্রমণে রেগে গেল। ভীমের পিছন পিছন তারাও দৌড়াল। 
তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করল –দেখ, এই পাপিষ্ট দুরাচার ক্ষত্রিয়রা স্বচক্ষে দেখল সভার মাঝে এই ব্রাহ্মণ-দ্বিজ লক্ষ্যভেদ করেছেন। নিজেদের শক্তি ছিল না, কিন্তু ব্রাহ্মণকে করতে দেখে প্রতিহিংসায় এতজন মিলে এক ব্রাহ্মণবধে চলেছে। এমন অন্যায় আমরা সহ্য করব না। যুদ্ধ করে আমরা সবাই প্রাণ দেব। আজ সবকটাকে যুদ্ধে মারব, এমন কর্ম সহ্য করব না। 

এসব বলতে বলতে ব্রাহ্মণরা হাতে দন্ড তুলে নিল। হরিণের চামড়া শরীরে দৃঢ় ভাবে বেঁধে নিল। লক্ষ লক্ষ্ ব্রাহ্মণ বায়ুবেগে দৌড়ে গেল রাজাদের দিকে। 

দেখে অর্জুন কৃতাঞ্জলি করে ব্রাহ্মণদের পায়েরধূলি গ্রহণ করলেন। বিনয়ের সঙ্গে বলেন –আপনারা এখানে এলেন কেন! আপনারা দাঁড়িয়ে দেখুন কি হয়। যাদের মুখের বচনে ভস্ম করেন, তাদের সাথে যুদ্ধ করা আপনাদের শোভা পায় না। আপনাদের চরণ প্রসাদে আমি অনায়াসে দুষ্ট ক্ষত্রিয়দের মারব। যে ভাবে এরা অন্যায় করল তার উচিত শিক্ষা এরা এখানেই পেয়ে যাবে। 
এভাবে ব্রাহ্মণদের নিবৃত্ত করে অর্জুন রাজাদের উদ্দেশ্যে ধেয়ে গেলেন। 

সব দেখে হেসে বলরাম কৃষ্ণকে বলেন –আমি আগে যা বলেছিলাম দেখ তাই হল। একলক্ষ রাজা সসৈন্য নিয়ে অর্জুনকে ঘিরে ধরেছে। একা পার্থ কত জনকে বাঁধা দেবে! এর তো কোন প্রতিকারই দেখছি না। রাজারা সবাই প্রতিজ্ঞা করেছে ব্রাহ্মণকে মেরে কন্যাকে দুর্যোধনের হাতে তুলে দেবে। 

 
বলরামের কথায় কৃষ্ণ দুঃখিত হলেন। করুণায় নয়ন বিকশিত হল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি বলেন –হে যাদববীর! যা বললেন তা সত্য। একলক্ষ রাজারা একজন মানুষকে মারতে উদ্যত। কিন্তু অর্জুনের পরাক্রম সম্পর্কে আপনি জ্ঞাত নন। যদি সুরাসুর ও মনুষ্য এক সাথে অর্জুনের সাথে বিবাদ করে তবু সে মুহুর্তে সসাগর ভূমি জয় করতে পারে। সে হচ্ছে দুর্গম বনে মদমত্ত বাঘের মত, তাকে কি করতে পারে ছাগরূপ রাজারা! তুমি বললে রাজারা তাকে মেরে কন্যা দুর্যোধনকে দেবে। কিন্তু সাধারণ মানুষ কবে কোথায় চাঁদ ধরতে পারে! বাঘের মুখে শেয়াল কবেই বা মাংস ধরে। তবে যদি দেখি অর্জুনের বিপদ উপস্থিত তখন সুদর্শনচক্রে আমি সবাইকে ছেদ করব। 

শুনে বলরাম মনে মনে ভয় পেলেন। তাঁর শিষ্য দুর্যোধনকে তিনি স্নেহ করতেন। পান্ডবদের শত্রু এই ছলে যদি কৃষ্ণ তাকে বশ করেন এই ভেবে তিনি কৃষ্ণকে বলেন –আমাদের এই যুদ্ধের মধ্যে যাওয়ার দরকার নেই। বিশেষত আপনার মতে যখন অর্জুন অনায়াসে এদের হারাবেন। আমরা বরং এখান থেকে যুদ্ধ দেখি। 

গোবিন্দ(কৃষ্ণ) বলেন –আমি যুদ্ধে যাব না। আপনার আজ্ঞা লঙ্ঘন করব না। পার্থকে ত্রিভুবনে জয় করার মত শক্তি কারো নেই। এক্ষুনি তা দেখতে পাবেন। আমার কথা না ফললে সুমেরু টলে যাবে, সিন্ধুর জল শুকাবে, দাবানলও চিরদিনের মত শীতল হবে। দিনমনি সূর্যও যদি পশ্চিমে উদয় হন তবুও কেউ যুদ্ধে অর্জুনকে পরাজিত করতে পারবে না। 

গোবিন্দের মুখে অর্জুনের এত কথা শুনে বলরাম চুপ করে গেলেন। একলক্ষ রাজারা পার্থকে ঘিরে ফেলল। কিন্তু পার্থ ব্যাঘ্রের মত মৃগরূপী রাজাদের সম্ভ্রম দেখালেন না। মহাবীর অর্জুন হিমাদ্রি পর্বতের মত অনড়। সমুদ্রের মত তাঁর গভীর বুদ্ধি। জন্তুদের মধ্যে যেন কালান্ত যম। ইন্দ্রের সন্তান ইন্দ্রের মতই পরাক্রমী। বৃক্ষ যেমন অনায়াসে বৃষ্টিধারা মাথা পেতে নেন, তেমনি অর্জুন রাজাদের বাণবৃষ্টি সহ্য করলেন। 
দেবতারা এই দৃশ্য দেখে অর্জুনের জন্য চিন্তিত হলেন। একা পার্থের লক্ষ বিপক্ষ। তাঁর হাতে আছে মাত্র তিনটি অস্ত্র লক্ষ্যভেদের জন্য। পুত্রকে সাহায্যের জন্য দেবরাজ ইন্দ্র দ্রুত অস্ত্রপূর্ণ তূণ(বাণ রাখার পাত্র) পাঠিয়ে দিলেন। প্রসাদরূপে পুত্রকে তিনি বৈজয়ন্তী মালাও পাঠালেন। 
খুশি হয়ে অর্জুন সিংহনাদ ছাড়েন। ধনুকে টঙ্কার দিয়ে নিমেষে সকল শরবৃষ্টি রোধ করেন। যেন মহাবাতাস এসে মেঘমালা উড়িয়ে দিল, সমুদ্রের ঢেউ সহজেই ভেলা উল্টে দিল। শিশুরা যেমন গেন্ডু(বল) খেলে, রাজারাও তেমনি যুদ্ধ যুদ্ধ খেলছিল। দাবাগ্নি যেমন ভাবে বৃষ্টির জলে শেষ হয়, তেমনি পার্থও নিমেষে তাদের শান্ত করলেন। 

মহাভারতের কথা সুধাসিন্ধুর সমান। কাশীদাস কহেন এবং সর্বদা সাধুরা তা পান করেন। 
................................... 

Sunday, February 22, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৮০

[পূর্বকথা - দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে ভাই ধৃষ্টদ্যুম্ন ক্ষত্রিয়দের বারবার লক্ষ্যভেদের জন্য অনুরোধ জানাতে লাগলেন...শেষে অর্জুন যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞায় লক্ষ্য ভেদ করতে উঠলেন... তিনি গুরুজনদের প্রণাম জানালেন...কৃষ্ণ বলরামকে বলেন তিনি অর্জুনকে সর্বপ্রকার সাহায্য করবেন ... ] 

অর্জ্জুনের লক্ষ্যবিদ্ধ করণঃ 
 

অর্জুন ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালেন। যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণদের দিকে তাকিয়ে বললেন –লক্ষ্যভেদকারী ব্রাহ্মণ আপনাদের প্রণাম জানাচ্ছেন। আপনারা সবাই তাকে আশীর্বাদ করুন। 
শুনে ব্রাহ্মণমন্ডলী ‘স্বস্তি, স্বস্তি’ রবে কল্যাণবানী শোনালেন ও লক্ষ্যভেদ করে দ্রুপদনন্দিনীকে প্রাপ্তির আশীর্বাদ জানান। 

ধনুক নিয়ে ধনঞ্জয় অর্জুন পাঞ্চালরাজকে বলেন –নিশ্চিত করে বলুন কি বিদ্ধ করব এবং সেটি কোথায় স্থাপিত। 

ধৃষ্টদ্যুম্ন বলেন –এই জলে দেখুন। চক্রছিদ্রপথে মৎস দেখতে পাবেন। সোনার মাছ তাঁর মাণিক নয়ন। সেই মাছের চোখে যিনি লক্ষ্যভেদ করবেন তিনিই আমার ভগিনীর বল্লভ(পতি) হবেন। 

এত শুনে পার্থ মহাবীর জলের দিকে তাকিয়ে ঊর্দ্ধবাহু করে আকর্ণ গুণ টেনে অধোমুখে বাণ ছারেন। জগন্নাথ কৃষ্ণও তাঁর সুদর্শন অদৃশ্য করেন। সহজেই অর্জুনের শর মৎসচক্ষু ছেদ করল। মহা শব্দে শর মৎসকে ছেদ করেই পুনরায় তাঁর সামনে এলো। 

আকাশ থেকে দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করলেন। সভার ব্রাহ্মণরা ‘জয়, জয়’ ধ্বনি দিতে লাগলেন। লক্ষ্যভেদ হয়েছে –এই বলে মহা হৈহল্লা শুরু হল। 
দেখে শুনে সব রাজারা অবাক হল। 

হাতে দৈয়ের পাত্র ও পুষ্পমালা নিয়ে দ্রুপদকন্যা ব্রাহ্মণরূপী অর্জুনকে বরণ করতে এলেন। সকল রাজারা বিস্মিত হয়ে তাকে ডেকে ‘রহ, রহ’ ডাক দিল। 
তারা যাজ্ঞসেনী(দ্রৌপদী)কে বাঁধা দিয়ে বলে –এতো ভিক্ষুক, দরিদ্র হীনজাতি। লক্ষ্যভেদ করার শক্তি এ পায় কোথা থেকে! মিথ্যে কেন ব্রাহ্মণমন্ডলী গোলমাল কর। গোল করে বামুনের কন্যা পাওয়ার ইচ্ছা। ব্রাহ্মণ বলেই সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি। না হলে এর উচিত শিক্ষা আমরা দিতে পারি। পাঁচক্রোশ উপরে লক্ষ্য শূণ্যে আছে। লক্ষ্য ঠিকঠাক বিদ্ধ হল কিনা কে যানে ‘বিঁধেছে, বিঁধেছে’ করে লোক জানানো হচ্ছে! দেখি কোথায় মৎস আর তা কেমন বিদ্ধ হয়েছে। 

তখন ধৃষ্টদ্যুম্ন সহ বহু ব্রাহ্মণ জলে তা দেখতে গেল। দুষ্টেরা বলল বেঁধেনি, শিষ্টেরা বলল বিঁধেছে। 
দুষ্টমতির লোকজন বলতে লাগল -ছায়া দেখে কিভাবে বিশ্বাস হবে। শূণ্য থেকে যদি মাছটা কেটে পড়ত তবে বোঝা যেত। যদি সত্যিই শক্তি থাকে তবে মাছটাকে কেটে পাড়। সব শুনে বিস্মিত হলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন। 

তখন বীর অর্জুন হেসে বলেন –অকারণে কেন সবাই মিথ্যে বিবাদ কর। যে মিথ্যে কথা বলে তাঁর দ্বারা আসলে কোন কাজ হয় না। জলের তিলক কতক্ষণ কপালে থাকে, তেমনি শূণ্যে শিলা মারলে কতক্ষণ তা শূণ্যে থাকে! সব সময় দিন বা রাত্রি থাকে না। মিথ্যে মিথ্যেই। তেমনি সত্য যা তা সত্য বলেই লোকের কাছে সত্য। অকারণে মিথ্যে বলে সব নষ্ট করলে। সবাই দেখুক আমি লক্ষবার এমন লক্ষ্যভেদ করে দেখাতে পারি। তাই একবার নয়, যতবার বলবে ততবার লক্ষ্যভেদ করে এই সভাতেই দেখাতে পারি। 

 
এই বলে অর্জুন তীর ধনুক তুলে নিলেন। ধনুকে গুণ পরিয়ে আকর্ণ টেনে তীর ছুড়লেন দৃঢ ভাবে। সুরাসুর-নাগ-নর সকলে কৌতুহলের সঙ্গে দেখলেন লক্ষ্য কেটে সভার সামনে পরল। দেখে সব রাজারা অবাক হল। ব্রাহ্মণরা আবার জয় জয় ধ্বনি দিতে লাগল। 
হাতে দধিপাত্র ও মালা নিয়ে দ্রৌপদী সুন্দরী পার্থের কাছে গিয়ে কৃতাঞ্জলি করেন। কিন্তু অর্জুন দধিমাল্য দিতে বারণ করলেন। 

দেখে রাজারা অনুমান করে বলে –দেখ ব্রাহ্মণ নিজেই বরণ করতে নিষেধ করছে। সহজেই বোঝা যায় দরিদ্র ব্রাহ্মণের অন্নও হয়ত মেলে না। পায়ে ছিন্ন পাদুকা, অতি দরিদ্র তাই পরিধানে জীর্ণ বস্ত্র, তেলহীন চুল জটায় আচ্ছন্ন। এমন লোকের ঘরে কি রাজকন্যা শোভা পায়! সেই জন্য বরণ করতে বারণ করছে। আসলে এ ধনলোভী। ব্রহ্মতেজে, তপস্যার সাহায্যে লক্ষ্যভেদে সক্ষম হয়েছে। যার অন্ন পর্যন্ত নেই তাঁর কাছে গিয়ে কন্যা কি করবে। চর পাঠিয়ে খোঁজ নাও দেখবে এই ব্রাহ্মণের মনে অনেক ধন প্রত্যাশা আছে। 

এই বলে রাজারা বিচার করে অর্জুনের কাছে ব্রাহ্মণদূত পাঠালো। দূত অর্জুনের কাছে গিয়ে বলে –শুনুন ব্রাহ্মণ! রাজারা আমায় আপনার কাছে পাঠালেন। তাদের কথাই আমি আপনার সামনে নিবেদন করছি। তোমার মত অসাধ্য কর্ম কেউ করতে পারেনি। দুর্যোধন আপনাকে নিবেদন করেছেন যে তিনি আপনাকে তাঁর সভার মুখ্যপাত্র করে রাখবেন। বহু রাজ্য, দেশ, ধন ও নানা রত্ন দেবেন। একশত কুমারী ব্রাহ্মণ কন্যার সাথে বিবাহ দেবেন। আর যা যা চাইবেন সবই তিনি দিতে সক্ষম। কেবল তার পরিবর্তে তাকে দ্রুপদকন্যা দান করতে হবে। 

শুনে অর্জুন আগুনের মত জ্বলে উঠলেন। দুই চোখ লাল করে তিনি দূতকে বলেন –ওহে দ্বিজ, কি কথা বল! তুমি অবধ্য ব্রাহ্মণ তাই আজ বেঁচে গেলে আমার হাত থেকে। যদিও তোমার কিবা দোষ! তুমিতো দূত মাত্র। ঠিক আছে আবার আমার দূত হয়ে যাও। দুর্যোধন আর অন্য রাজাদেরও বলো তাদের যদি মনে ইচ্ছে থাকে ধনের তবে আমি সবাইকে পৃথিবী জয় করে কুবেরের নানা ধনরত্ন এনে দেব। কেবল তোমাদের সবার স্ত্রীকে আমায় দান করতে হবে। এই কথা তুমি সভাস্থলেই বলবে। 

একথা শুনে দ্রুত দ্বিজদূত সভায় গিয়ে রাজাদের সামনে সব কথা বললো। জ্বলন্ত আগুনে ঘি পরলে যেমন জ্বলে তেমনি সব শুনে রাজারা ক্রোধে বলে –দেখ কেমন বামুনের মতিচ্ছন্ন হয়েছে। লক্ষ্যভেদ করে তাঁর অহঙ্কার হয়েছে। রাজাদের এমন কথা বলার সাহস সে যখন দেখালো এর উচিত শাস্তিও সবাই মিলে দেবো। প্রাণের আশা থাকলে কেউ রাজাদের এত বড় কথা বলতে সাহস পায় না। ব্রাহ্মণ বলে ভাবছে যা খুশি করতে পারে, কেউ মারবে না। কিন্তু একে মারলে কোন পাপ হবে না। এমন কুৎসিত বাক্য কে সহ্য করবে। বিশেষ করে এ স্বয়ম্বর ব্রাহ্মণের জন্য ছিল না। ক্ষত্রিয়ের স্বয়ম্বরে বামুনের কি কাজ! বামুন হয়ে কন্যা নিয়ে গেলে তা ক্ষত্রিয়কূলের লজ্জা হবে। এ যদি বেঁচে থাকে তবে সব ব্রাহ্মণও এর মত দুষ্ট মতির হবে। সে কারণে একে ক্ষমা করা যায় না। অন্য কোন স্বয়ম্বরে যেন এমন না হয় সেটা আমাদেরই লক্ষ্য রাখতে হবে। দ্রুপদরাজার ভাগ্যটাই খারাপ। আমাদের কথা না শুনে অহঙ্কার করে ব্রাহ্মণদের লক্ষ্যভেদে আহ্বান জানাতে গেল। যে কন্যাকে ঈশ্বর, কিন্নররাও মনে মনে চায় সে যাবে দরিদ্র বামুনের ঘরে! এ কুৎসিত কাজ কে সহ্য করতে পারে! আজ দ্রুপদকেও মারতে হবে তাঁর পুত্রের সাথে। সেই সাথে এই ব্রাহ্মণকেও বধ করতে হবে। 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীদাস কহে সদা শুনে পুণ্যবান। 
................................... 

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৭৯

[পূর্বকথা - দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে রাজারাকেউই লক্ষ্যভেদে সক্ষম হল না...রাজারা ক্রুদ্ধ হল...শ্রীকৃষ্ণ বলরামকে বলেন এক মাত্র অর্জুনই এ লক্ষ্য ভেদ করবেন...দ্রৌপদীর ভাই ধৃষ্টদ্যুম্ন ক্ষত্রিয়দের বারবার লক্ষ্যভেদের জন্য অনুরোধ জানাতে লাগলেন...শেষে অর্জুন যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞায় লক্ষ্য ভেদ করতে উঠলেন...

অর্জুনের লক্ষ্যভেদে গমনঃ 

 

রাজারা যখন পরস্পর আলোচনায় ব্যস্ত সে সময় কুন্তীপুত্র অর্জুন ধনুকের কাছে যান। প্রথমেই তিনি তিনবার ধনুকটিকে প্রদক্ষিণ করেন। বরদাতা মহাদেবকে প্রণাম জানালেন। বাম হাতে অনায়াসে ধনুক তুলে নিলেন। কর্ণের পরান গুণ খুলে ফেললেন। পুনরায় গুণ পরিয়ে ধনুকে টঙ্কার দিলেন। সেই শব্দে সকলের কানে তালা লেগে গেল। 

মনে মনে তিনি গুরুকে প্রণাম করতে চাইলেন। কিন্তু এই অজ্ঞাতবাসকালে ছদ্মবেশে কিভাবে তা সম্ভব! 
গুরু দ্রোণাচার্য এক সময় বলেছিলেন –আমাকে যদি প্রণাম করতে চাও তাহলে প্রথমে এক অস্ত্র মেরে সম্বোধন করবে। অন্য অস্ত্র মেরে পায়ে প্রণাম জানাবে। সে কথা মনে করে পার্থ চিন্তা করলেন এবং দুটি তীর ছুঁড়লেন। বরুণ অস্ত্রে গুরুর চরণ ধৌত করলেন। অন্যটি গুরুর চরণের সামনে এসে তাঁকে প্রণাম জানালেন। 

দ্রোণাচার্য আশ্চর্য হয়ে আশীর্বাদ জানালেন। 
দ্রোণ বিস্মিত হয়ে চিন্তিত হন –এই আমার প্রিয় শিষ্য অর্জুন হবে। 
কুরুশ্রেষ্ঠ পিতামহ গঙ্গাপুত্র ভীষ্মকেও অর্জুন নমস্কার জানালেন। 

দ্রোণ তখন ভীষ্মকে বলেন -শান্তনুপুত্র! দেখুন যে ব্রাহ্মণ লক্ষ্যভেদ করতে উঠেছেন, তিনি আপনাকে প্রণাম জানাচ্ছেন। 

ভীষ্ম বলেন –আমি ক্ষত্রিয়, উনি ব্রাহ্মণ হয়ে আমাকে কি কারণে প্রণাম জানাচ্ছেন! 

দ্রোণ বলেন -ইনি কখনই ব্রাহ্মণ হতে পারেন না। ক্ষত্রিয়কুলশ্রেষ্ঠ কেউ এমন ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ নিয়েছেন। যে বিদ্যা এখনি আমাদের সামনে ইনি দেখালেন এ কেবল আমার প্রিয় শিষ্যের পক্ষেই সম্ভব। বড় বড় রাজারাও যা জানেন না, তা ভিক্ষু ব্রাহ্মণ শিখবে কি ভাবে। বিশেষ করে ইনি আপনাকে যে ভাবে প্রণাম জানাচ্ছেন তাতে বোঝা যায় ইনি আপনার বংশেই জন্মেছেন।এখনি এ ছদ্মবেশ মুছে যাবে, কতক্ষণ জ্বলন্ত আগুনকে লুকিয়ে রাখা যায়! 

ভীষ্ম বলেন –তাই তো! আমিও তাই ভাবছি, একে যেন কোথায় দেখেছি মনে হচ্ছে। ওর সুন্দর চন্দ্রমুখ দেখে আমার যে অন্তরে কি দুঃখ জন্মাচ্ছে বলে বুঝাতে পারব না। বলুন গুরুদেব আপনি এর সম্পর্কে আর কি কি জানেন। কার পুত্র, কি এঁনার নাম! 

দ্রোণাচার্য বলেন –আমি এখনি এঁনার পরিচয় প্রকাশ করতে পারি। তবে স্বপক্ষ ও বিপক্ষ দেখে মনে ভয় হয়। বিশেষ করে যে অনেকদিন মৃত বলে সবাই জানে, তাঁর নাম নেওয়া ঠিক হবে কিনা ভাবছি। 

ভীষ্ম আকুল হয়ে প্রশ্ন করেন –গুরুদেব বলুন কি ভয় পাচ্ছেন! কে মারা গেছে! কার কথা ভাবছেন! 

দ্রোণ বলেন –যে বিদ্যা ইনি দেখালেন, এ আমার প্রিয় পার্থ ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। অনেকদিন আগে আমি অর্জুনকে বলেছিলাম তোমার মত আর কাউকে আমি শিষ্য করব না। সে কারণেই এই বিদ্যা কেবল তোমাকেই দিচ্ছি। আমাকে একদিন আমার গুরু ভৃগুপুত্র পরশুরাম যা শিখিয়েছিলেন নিজপুত্র অশ্বত্থামাকেও তা না শিখিয়ে তোমাকে শেখালাম। আজ তাই ইনি দেখালেন, তাই আমার মন বলছে ইনি অর্জুন ছাড়া আর কেউ হতে পারেন না। 

পার্থ অর্জুনের নাম শুনে পিতামহ ভীষ্ম শোকাকুল হলেন। দুই চক্ষু দিয়ে অঝরে জল ঝরতে লাগল। 
তিনি আকুল হয়ে বললেন –কি বললেন আচার্য! একি কাজ করলেন! নিভন্ত অগ্নিকে জ্বালিয়ে আমার অন্তরকে আবার দগ্ধ করছেন! বারো বছর হয়ে গেল তাদের কথা শুনলাম না, দেখতেও পেলাম না। সেই সাধু পুত্রদের আর কোথায় পাবো! 
এই বলে ভীষ্ম ক্রন্দন করতে লাগলেন। 

দ্রোণ বলেন –ভীষ্ম, শোক ত্যাগ করুন। নিশ্চিন্ত ভাবে জানুন ইনিই কুন্তীর পুত্র। দেবতার সাহায্যে পঞ্চপান্ডবের জন্ম। সকলে বলে তারা মৃত কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস তারা জীবিত আছেন। বিদুরের মন্ত্রণায় তারা অবশ্যই বেঁচে গেছে- একথা আমি দিনরাত ভাবি। মুনিদের এমন উক্তিও শোনা যায় এই পৃথিবীর ভূমিতে পান্ডবদের মরণ নেই। 

এই কথা শুনে বীর ভীষ্ম ক্রন্দন ত্যাগ করলেন এবং দুজনেই আনন্দমনে আশীর্বাদ জানালেন -যদি এই কুন্তীপুত্র ফাল্গুনি(অর্জুন) হন তবে ইনিই লক্ষ্যভেদ করে দ্রুপদ নন্দিনীকে গ্রহণ করুন। 

এরপর পার্থ যোড়হাতে কৃষ্ণকে প্রণাম জানালেন। এঁনার হাতেই তাঁর জন্য পাঞ্চজন্য শঙ্খবাদ্য বেজে উঠেছে। দেখে কৃষ্ণ হেসে তাকে শুভেচ্ছা জানালেন। 
হেসে কৃষ্ণ বলরামকে বলেন – দেখুন হে, রেবতীর স্বামী! আপনাকেও ইন্দ্রের পুত্র পার্থ প্রণাম জানাচ্ছেন। আশীর্বাদ করুন পার্থ যেন লক্ষ্যভেদে সক্ষম হন। 
শুনে বলরামের হৃদয় চঞ্চল হল। তিনি বলেন –অর্জুন লক্ষ্যভেদে সক্ষম হবেন। কিন্তু কন্যা নিয়ে যাওয়ার সাধ্য হবে না। একা ধনঞ্জয়ের এত শত্রু! এক লক্ষ রাজারা সসৈন্য এসেছেন। অনুপমরূপা কৃষ্ণা মদনমোহিনী, তিনি সবার মন হরণ করেছেন। সে জন্য সবাই প্রাণপণ চেষ্টা করবে। কন্যাকে নিয়ে যুদ্ধ আসন্ন। বিশেষত পার্থকে সকলে ব্রাহ্মণ বলেই জানছেন। এতজনকে একা পার্থ অর্জুন কি ভাবে পরাজিত করবেন! 

কৃষ্ণ বলেন –দুষ্টরা অন্যায় করবে আর আমরা বসে কি তা দেখবো! আমার সামনে যদি এমন বলপ্রয়োগ করে তবে আমার জগন্নাথ নাম মিথ্যে। জগতে সৎ ব্যক্তির অন্তে আমি হই ত্রাতা, দুর্বলের বল ও সর্ব ফলদাতা। আমিই যদি উপযুক্ত ফলপ্রদান না করি তবে জগন্নাথ নাম ধারণ করব কেন! সুদর্শনচক্রে সকল দুষ্টমতিকে বিনষ্ট করব। পূর্বেও পরশুরাম পৃথিবীকে ক্ষত্রিয় শূণ্য করেছিলেন। আমিও প্রয়োজনে পৃথিবীর ভার লাঘব করব। সে জন্যেই পৃথিবীতে আমার জন্ম। 

গোবিন্দের কথায় বলরাম মনে মনে চিন্তিত হলেন। কৃষ্ণের অনুরোধে তিনি অর্জুনকে আশীর্বাদ করলেন। 

মহাভারতের কথা অমৃত লহরী, কাশীরাম দাস কহেন যা শুনলে সব পাপে পার হয় মানব-মানবী। 
................................... 

Wednesday, February 18, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৭৮

[পূর্বকথা দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে রাজারাকেউই লক্ষ্যভেদে সক্ষম হল না...রাজারা ক্রুদ্ধ হল...শ্রীকৃষ্ণ বলরামকে বলেন এক মাত্র অর্জুনই এ লক্ষ্য ভেদ করবেন...] 

সকলকে লক্ষ্য বিন্ধনে ধৃষ্টদ্যুম্নের অনুমতিঃ 
 

দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে ভাই ধৃষ্টদ্যুম্ন ক্ষত্রিয়দের বারবার লক্ষ্যভেদের জন্য অনুরোধ জানাতে লাগলেন। 
তাঁর এই পুনঃপুনঃ অনুরোধ শুনে কুরুবংশপতি মহামতি ভীষ্ম উঠে এলেন। ধনুকের কাছে গিয়ে তাকে টেনে তুললেন। বাম হাঁটু ভেঙে বসে মহাধনু নত করে গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম মহা টঙ্কার দিলেন। সেই মহাশব্দে সকলে মোহিত হলেন। 

গঙ্গাপুত্র উচ্চস্বরে বলেন–শুনুন পাঞ্চাল নরেশ ও অন্যান্য রাজনগণ। সবাই জানেন আমি স্ত্রী গ্রহণ করব না। লক্ষ্যভেদ করে আমি কন্যাকে দুর্যোধনের হাতে তুলে দেব। 
এত বলে ভীষ্ম ধনুকে বাণ জুড়লেন। ঠিক সে সময় তিনি শিখন্ডীকে দেখলেন। ভীষ্ম প্রতিজ্ঞা করেছিলেন অমঙ্গল দেখলে ধনুঃশর ত্যাগ করবেন। শিখন্ডী দ্রুপদরাজার পুত্র তবে নপুংসক। তাকে দেখেই ভীষ্ম ধনুক রেখে দিলেন। 

ভীষ্মকে ধনু ত্যাগ করতে দেখে ধৃষ্টদ্যুম্ন দুঃখিত হয়ে পুনরায় সকল জাতির মানুষকে লক্ষ্যভেদে আহ্বান জানালেন - ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র-যে কেউ লক্ষ্যভেদে সক্ষম হবেন কৃষ্ণা তাঁরই হবেন। 

এত শুনে দ্রোণ উঠে এলেন। মাথায় তাঁর শুভ্র উষ্ণীষ(পাগড়ি), শুভ্র মলয়জে(চন্দনে) শুভ্র অঙ্গ, হাতে ধনুর্বাণ, পিঠে নিষঙ্গ(বাণ রাখার স্থান)। 

ধনুক হাতে নিয়ে দ্রোণ বলেন–আমি যদি লক্ষ্যভেদে সক্ষম হই তবু দ্রুপদকন্যা আমার জন্য নয়, সে আমার বন্ধুর কন্যা আমারও কন্যা সমান। আমিও কন্যাকে দুর্যোধনের হাতে তুলে দেব। 
এত বলে বাম হাতে তিনি ধনুক তুলে টঙ্কারের সাথে গুণ পরালেন। তাঁর অবলীলায় এ কর্ম দেখে মনে হল তিনি সহজেই লক্ষ্যভেদ করবেন। লক্ষ্য দেখতে তিনি জলের ছায়ার দিকে দেখলেন। বুঝলেন দ্রুপদ অপূর্ব লক্ষ্য রচনা করেছেন। পঞ্চক্রোশ উঁচুতে সোনার মৎস আছে। তাঁর অর্ধেক পথে রাধাচক্র ঘুরছে। অদ্ভুত তৈরী চক্রটি দ্রুত ঘুরে যাচ্ছে। তাঁর মাঝে একটি ছিদ্র আছে যার মধ্যে দিয়ে কেবল একটি বাণই যেতে পারে। মাথা উঠিয়ে মাছটিকে একবার দেখতে চাইলে তাকে দেখা যায় না। কিন্তু জলের ছায়ায় ছিদ্রপথে মৎস দেখা যাচ্ছে। নিচের দিকে মুখ করে মাছের ছায়া দেখে লক্ষ্যস্থির করে উপর দিকে বাণ চালিয়ে লক্ষ্যভেদ করতে হবে। দ্রোণ ধনুক টেনে জলের ছায়া দেখতে থাকেন। 
 
তা দেখে যদুরায়(কৃষ্ণ) চিন্তিত হলেন। তিনি ভাবেন –দ্রোণ পরশুরামের শিষ্য। নানা বিদ্যা অস্ত্রশস্ত্রে তিনি পারদর্শি। বিশেষ করে ধনুর্বেদে তিনি সবার গুরু ও সকল সৃষ্টিভেদে পারঙ্গম। এই লক্ষ্যভেদও তাঁর পক্ষে অসম্ভব নয়, এক্ষুনি তিনি হয়ত তা ভেদ করলেন। এই ভেবে তিনি তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে রাধাচক্রকে আবৃত করলেন। মৎসলক্ষ্য ঢাকা পরে সেই সুদর্শন চক্রে। এদিকে দ্রোণাচার্য বাণ আকর্ণ টেনে ধরলেন এবং জলের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্যস্থির করে বাণ ছারলেন। মহাশব্দে বাণ আকাশের দিকে ধাবিত হল। কিন্তু সুদর্শনচক্র স্পর্ষ করে মাটিতে এসে পরে গেল। লজ্জিত হয়ে দ্রোণ ধনুক রেখে সভায় অধোমুখে এসে বসলেন। 

পিতার লজ্জা দেখে দ্রোণি অশ্বত্থামা রাগে ফেটে পরলেন। তিনি এসে বাহাতে ধনুক উঠালেন। ধনুকে টঙ্কার দিয়ে জলের দিকে দেখে চক্র ছিদ্রপথের উদ্দেশ্যে বাণ ছুড়লেন। উল্কার মত বাণ গর্জিয়ে ছুটল কিন্তু রাধাচক্রে ঠেকে খানখান হয়ে গেল। 

দ্রোণ ও দ্রোণিকে এভাবে বিফল হতে দেখে বিষম লজ্জার ভয়ে আর কেউ উঠে এলেন না। 
তখন সূর্যের পুত্র মহাবীর কর্ণ ধনুকের দিকে দ্রুত এগিয়ে গেলেন। পায়ে ভর দিয়ে বাম হাতে অনায়াসে ধনুক তুলে নিলেন। গুণ খসিয়ে পুনরায় গুণ পরালেন। ধনুক টঙ্কার দিয়ে বাণ জুড়লেন বীর কর্ণ। ঊর্দ্ধবাহু অধোমুখে লক্ষ্য স্থির করলেন ও বাণ ছুড়লেন। বাণ বায়ুর সমান বেগে ছুটল, জ্বলন্ত আগুন যেন অন্তরীক্ষে উঠল। কিন্তু সুদর্শনচক্রে ঠেকে বাণ চূর্ণ হয়ে গেল এবং খন্ড খন্ড হয়ে মাটিতে পরল। 
লজ্জা পেয়ে কর্ণ ধনুক মাটিতে ফেলে অধোমুখে সভায় গিয়ে বসে পরলেন। ভয়ে কেউ আর ধনুকের দিকে চেয়ে দেখে না। 

ধৃষ্টদ্যুম্ন আবার সবাইকে আহ্বান জানাতে থাকেন - ব্রাহ্মণ হোক, ক্ষত্রিয় হোক, বৈশ্য অথবা শূদ্র, এমন কি চন্ডাল বা যে কেউ লক্ষ্য ভেদ করুন, দ্রৌপদীকে সেই পাবে। 

এত অনুরোধ সত্ত্বেও কেউ ধনুকের কাছে যায় না। এভাবে একুশতম দিন কাটতে লাগল। 
এদিকে ব্রাহ্মণদের মধ্যে বসে যুধিষ্ঠির, চারভাই তাকে ঘিরে আছেন। দেখে মনে হয় দেবতাদের মাঝে যেন আখন্ডল(দেবরাজ ইন্দ্র) বসে আছেন। তাদের কাছেও এসে ধৃষ্টদ্যুম্ন তাদের লক্ষ্যভেদে আহ্বান জানালেন - যে লক্ষ্যভেদ করতে পারবেন এই সুন্দরী দ্রৌপদী তাঁর। 
একথায় ধনঞ্জয় অর্জুনের মন চঞ্চল হল। লক্ষ্যভেদে তাঁর ইচ্ছে হতে যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকালেন। 
অর্জুনের মনের ইচ্ছে বুঝতে পেরে যুধিষ্ঠির তাকে সম্মতি জানালেন। 
আজ্ঞা পেয়ে অর্জুন দ্রুত উঠে ধনুকের কাছে এগিয়ে যান। দেখে অন্য ব্রাহ্মণরা তাকে জিজ্ঞেস করেন –কোথায় যাচ্ছ তুমি, কি প্রয়োজনে সভার মাঝে উঠে যাচ্ছ! 

অর্জুন বলেন -আমি লক্ষ্যভেদ করতে যাচ্ছি। আপনারা আমায় আজ্ঞা দিন। 

শুনে ব্রাহ্মণরা হাসে। -কন্যাকে দেখে যে এ বামুনের মাথা খারাপ হল দেখছি! যে ধনুকে সকল রাজা পরাজিত-জরাসন্ধ, শল্য, শাল্ব, কর্ণ, দুর্যোধন! সেই লক্ষ্যভেদ করতে চায় এক সামান্য ব্রাহ্মণ কোন লজ্জায়! ক্ষত্রিয় সমাজে এ ব্রাহ্মণদের হাসাবে। সব ক্ষত্র বলবে ব্রাহ্মণ-দ্বিজরা লোভী। এমন বিপরীত আশা করা উচিত নয়। বহুদুর থেকে সব ব্রাহ্মণরা এসেছেন বহু ধনের আশায়। এই এক কর্মে সে সব নষ্ট হবে। অসম্ভব আশা কেন কর! এস অনর্থ না করে এখানে এসে বস। 
এসব বলে ব্রাহ্মণরা তাকে ধরে বসিয়ে দিল। 

কিন্তু দ্রুপদ রাজপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নকে বারংবার এসে অনুরোধ করতে দেখে অর্জুন আবার অস্থির হলেন। 
পুনরায় তিনি ওঠার ইচ্ছা প্রকাশ করতেই শ্রীপতি(কৃষ্ণ) শঙ্খনাদ দিলেন। পাঞ্চজন্য শঙ্খনাদে(পঞ্চজন নামের দৈত্যের অস্থি দিয়ে তৈরী) তিনলোক পূর্ণ হল। দুষ্ট রাজারা সেই শব্দে স্তব্ধ হয়ে গেল। শঙ্খধ্বনি শুনে অর্জুন আনন্দিত হলেন। ভয়াতুর জনও আশ্বাস পেল। অর্জুনের মনে হল শঙ্খধ্বনি দিয়ে যেন তাকে আহ্বান জানান হল লক্ষ্যভেদ করে দ্রৌপদীকে গ্রহণ করার জন্য। গোবিন্দের(কৃষ্ণের) ইঙ্গিতে অর্জুন উঠলেন। পুনরায় ব্রাহ্মণরা তাকে ধরতে গেল। তারা বলে –ব্রাহ্মণ হয়েও তুমি ক্ষেপে উঠলে! তোমার এই কাজের ফলে সমগ্র ব্রাহ্মণকুল বিপদে পরবে। আমাদের দেখে দুষ্ট 
ক্ষত্রিয়রা হাসবে। সবাই আমাদের লোভী ভাববে। শেষে সভা থেকে হয়ত আমাদের তাড়িয়েই দেবে। যা পাওয়া গেছে এতদিনে তাও সব কেড়ে নেবে। এসব বলে সকলে জোড় করে আবার অর্জুনকে বসিয়ে দিল। 

তা দেখে যুধিষ্ঠির এগিয়ে এসে ব্রাহ্মণদের বোঝাতে লাগলেন –কেন ওনাকে বাঁধা দিচ্ছেন। কার কত ক্ষমতা সে নিজে তা জানে। যে লক্ষ্যভেদে রাজারা পিছু হটল শক্তি না থাকলে কে সে দিকে যাবে। যদি লক্ষ্যভেদ না পারে তবে নিজেই লজ্জা পাবে। আমাদের কাউকে বাঁধা দেওয়া উচিত নয়। 

যুধিষ্ঠিরের বাক্য শুনে সকলে অর্জুনকে ছেড়ে দিল। 
ধনুকের কাছে অর্জুন এগিয়ে গেলে ক্ষত্রিয়রা হেসে তাকে উপহাস করে বলে –ব্রাহ্মণের দেখি অসম্ভব কাজের ইচ্ছে হয়েছে। সভার মাঝে ব্রাহ্মণের কি লজ্জা নেই! যার কাছে রাজার সমাজ পরাজিত সেই সুরাসুর জয়ী বিপুল ধনুকে লক্ষ্যভেদ করতে চলেছে এই ভিক্ষুক! কন্যার রূপ দেখে ব্রাহ্মণের মাথা খারাপ হয়েছে। অনুমান করি ইনি একজন পাগল। কিংবা মনেমনে ভাবছে দেখি একবার। পারলে পারবো না হলে আমার কিবা যাবে। কিন্তু এই নির্লজ্জ্ব ব্রাহ্মণকে আমরা অল্পে ছাড়ব না। উচিত শাস্তি দেব। 
 
কেউবা বলে -ব্রাহ্মণদের ওভাবে বোলো না। ইনি হয়ত সামান্য মানুষ নন। দেখ ব্রাহ্মণের মনসিজের(কামদেবের) মত মূর্তি। পদ্মের মত দুই টানাটানা আঁখি কর্ণকে স্পর্ষ করে। সুন্দর অনুপম তনু তাতে শ্যাম নীলোৎপল আভা। মুখেও পবিত্র সুন্দর শোভা। সিংহগ্রীবা, লাল ঠোঁট, নাকটি এত সুন্দর যে খগরাজ(গড়ুর)ও লজ্জা পাবেন। সুচারু যুগ্ম ভুরু ললাটে বিস্তৃত। কি সানন্দ মন্দ মত্ত গতি! বাহু দুটি নাগকে নিন্দা করবে এত সুন্দর আজানুলম্বিত। বুকপাটা ও জানু দুটি বলশালী করিকরের(হাতির) মত। দন্তছটা যেন বিদ্যুৎকে জয় করেছে। এর রূপ দেখে যে কোন কামিনী ধৈর্য্যচ্যুত হবেন। ইনি মহাবীর্য্যবন্ত যেন সূর্য ও জলদে(মেঘে) আবৃত। অগ্নি কিরণ যেন ছাইয়ে আচ্ছাদিত। দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি ইনি লক্ষ্যভেদ করে দেবেন। 

কাশী বলেন কৃষ্ণের জনের কি কোন কর্ম হয় অসাধ্য! 
................................... 

Monday, February 16, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৭৭

[পূর্বকথা - দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে সকল রাজারা ধনুকে গুণ পরিয়ে নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শন করতে শুরু করল কিন্তু কেউই লক্ষ্যভেদে সক্ষম হল না...রাজারা ক্রুদ্ধ হল...তারা ভানুমতীর স্বয়ম্বরের কথা আলোচনা করে, সেখানেও এমনই ব্যবস্থা ছিল কিন্তু কর্ণের সাহায্যে দুর্যোধন ভানুমতীকে পান।

শ্রীকৃষ্ণ-বলরামের কথোপকথনঃ 
 

জন্মেজয় পুনরায় দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায় আর কি কি হল জানতে চাইলেন। মুনি বলেন শুনুন তবে – রাজারা দ্রুপদকে কটু কথা বলতে থাকেন। উপহাস করে নৃপের দল দ্রুপদকে বলে- মিথ্যে স্বয়ম্বরের জন্য আমাদের নিমন্ত্রণ করলেন। আমাদের মধ্যে কারো এ লক্ষ্যভেদ সম্ভব নয় আপনি জানতেন। এখন আপনি তাকেই ডেকে নিন, যাকে আপনি নির্বাচন করে রেখেছেন সেই লক্ষ্যভেদকারীকে। 

রাজাদের এই বাক্য শুনে দ্রুপদকুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন সভার মাঝে সকলকে উদ্দ্যেশ্য করে বলেন –সভায় যে ক্ষত্রিয়রা আছেন তাদের মধ্যে যিনি লক্ষ্যভেদ করবেন কৃষ্ণা তাঁরই হবেন। তিনি রাজা হোন বা না হোন তাতে কিছু এসে যায় না। সেই লক্ষ্যভেদকারী শক্তিমানের গলাতেই দ্রৌপদী মালা দেবেন। 
ধৃষ্টদ্যুম্ন এই বলে বারবার সভার মানুষদের আমন্ত্রণ জানাতে লাগলেন। 

সে সময় বলরাম কৃষ্ণের দিকে তাকান। কৃষ্ণ তাঁর মনের ভাব বুঝে বলেন – আমাদের এখানে কোন কাজ নেই। সভায় উঠে কেবল লজ্জাই পাব। 

বলরাম বিরক্ত হয়ে বলেন – তা হলে আর কি কারণে এখানে বসে থাকা। দ্রুপদ দেখছি ব্যর্থ স্বয়ম্বর করেছেন। এক লক্ষ রাজাকে নিমন্ত্রণ করে কুড়িদিন সকলকে আদরযত্নে রাখলেন কিন্তু কেউই এই ধনুক নোয়াতে পারল না। তোমার মত বীরও যখন একাজে বিমুখ তখন সংসারে আর কারো পক্ষে এ লক্ষ্যভেদ করে দ্রৌপদীকে পাওয়া সম্ভব নয়। অকারণে আর এখানে থেকে কি হবে পনেরোদিন হয়ে গেল দ্বারাবতী(দ্বারকা) ছেড়ে আছি। 

গোবিন্দ(কৃষ্ণ) বলেন – আজকের দিনটা থেকে যাও। এই লক্ষ্যভেদ করার জন্য কি কৌতুক করি দেখ। এতক্ষণ কারো ক্ষমতা হল না এই লক্ষ্যভেদের। তবে একজনের পক্ষে এটা অবলীলায় সম্ভব। যিনি মনুষ্যলোকে শ্রেষ্ঠ ও মহা পরাক্রমী। 

শুনে বলরাম বিস্মিত হয়ে বলেন – বল কৃষ্ণ তিনি কে যার তিনলোকের শ্রেষ্ঠ বল। মনুষ্য মধ্যে তোমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কে আছে। আমার ও তোমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ মানুষও আছে যেনে যেমন আশ্চর্য লাগছে তেমনি হাসিও পাচ্ছে। লক্ষ্মীস্বরূপা অবর্নিতরূপা, চন্দ্রের মত মুখশ্রী, জাতিতে পদ্মিনী এমন সুন্দরী কন্যা দ্রৌপদীকে পাওয়ার জন্য আমাদের চেয়ে ক্ষমতাবান পুরুষ আর কে আছে। 

গোবিন্দ বলেন – শুনুন, এই লক্ষ্যভেদ একমাত্র পার্থের(অর্জুন) পক্ষেই সম্ভব। যিনি ইন্দ্রের পুত্র ও মধ্যম পান্ডব। 

শুনে বলরাম বলেন – তবে কৃষ্ণ এখানে আর থাকা কেন! এই তিনলোকে কারো পক্ষে যে কাজ অসাধ্য তা যে করতে পারেন সেও বারো বছর মৃত। আশ্চর্য লাগছে তোমার কথা শুনে। তুমি কি উপহাস করছ! পান্ডুর যে সন্তানটি আগুনে পুড়ে মারা গেল সে এসে কি ভাবে এ লক্ষ্যভেদ করতে পারে! 

কৃষ্ণ বলেন – পান্ডুর পুত্রেরা পুড়ে মারা যান নি। তারা মহা বীর্য্যবন্ত, এ সংসারে অবধ্য। দেবতাদের আশির্বাদে কুন্তীর এই পাঁচটি কুমারের জন্ম, তাদের অনেক কাজ এখনও বাকি। তাদের মারার শক্তি কারো নেই। অনেকদিন তারা বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করে আছেন। আজ তারা এই সভার মধ্যেই আছেন। 

শুনে বিস্মিত হয়ে বলেন রোহিনীপুত্র বলভদ্র(বলরাম)- অদ্ভূত কথা বললে শুনে আশ্চর্য হচ্ছি। পঞ্চপান্ডব অগ্নিতে পুড়ে মরল একথাই জগতে সবাই জানে। এতকাল কোন দেশে তারা রইল। কোথায়, কোন বেশে তারা এখন আছে! পার্থ কেন লক্ষ্যভেদ করতে উঠে দাঁড়াচ্ছে না। 

কৃষ্ণ বলেন–ভাল করে ব্রাহ্মণের দলটিকে লক্ষ্য করুন যুধিষ্ঠিরকে চিনতে পারবেন। এখনই ধনঞ্জয়(অর্জুন) লক্ষ্যভেদ করতে কি ভাবে উঠবেন। তাদের তো এখনও আমন্ত্রণ জানানো হয় নি। যখন দ্রপদ ব্রাহ্মণদের লক্ষ্যভেদে আমন্ত্রণ জানাবেন, তখনই অর্জুন উঠবেন। 

সব শুনে বলরাম ভাল করে চেয়ে দেখেন পিঙ্গল(অগ্নিবর্ণ) মলিন বস্ত্রে বিরস বদন, তেলবিনা তাম্রবর্ণ বড় চুল, সাথে তালপাতার ছাতা, কাঁধে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে যুধিষ্ঠিরকে। 
তিনি দুঃখিত হয়ে কৃষ্ণকে বলেন – ধর্মশ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠির, সকলের মাঝে বিখ্যাত, তাঁর এমন গতি হল কেন। অনাহারে মহাক্লিষ্ট দুঃখিত শরীর। অন্যদিকে রাজা দুর্যোধন তার অতুল বৈভব নিয়ে সভা মাঝে দ্বিতীয় দেবরাজ ইন্দ্রের মত বসে। 

গোবিন্দ বলেন –অবধান করুন, দুর্যোধন পাপাত্মা। পাপেতে পাপীর ধনবৃদ্ধি হয় সহজে, কিন্তু শেষে সমূলে তাঁর বিনাশ ঘটে। কালে অবশ্যই জয়লাভ করেন ধার্মিক জন। সুখ ও দুঃখ তো কালের লিখন। 
কৃষ্ণের একথা শুনে যদুবীরেরা সবাই লক্ষ্যভেদের ইচ্ছে ত্যাগ করলেন। 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীদাস কহে সদা শুনে পুণ্যবান। 
.................................... 

Saturday, February 14, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৭৬

[পূর্বকথা - দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরের আয়োজন চলছে... দ্রুপদের আমন্ত্রণে সকল দেশের রাজারা যেমন এলেন, দেবতারাও উপস্থিত হলেন...দ্রৌপদী সভায় উপস্থিত হলেন, সকল রাজারা ধনুকে গুণ পরিয়ে নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শন করতে শুরু করল কিন্তু কেউই লক্ষ্যভেদে সক্ষম হল না...রাজারা ক্রুদ্ধ হল...তারা ভানুমতীর স্বয়ম্বরের কথা আলোচনা করতে থাকে... ] 

ভানুমতীর স্বয়ম্বরঃ 
 
মুনি বলেন - অবধান করুন মহারাজ জন্মেজয়- 
প্রাগ্‌জ্যোতিষের(কামরূপের) রাজা ভগদত্তের কন্যা ভানুমতী। রাজা কন্যার স্বয়ম্বরের আয়োজন করেন। সকল রাজারা নিমন্ত্রিত হয়ে এলেন। দুর্যোধন ও তাঁর শতভাই, ভীষ্ম, কর্ণ, দ্রোণ, কলিঙ্গ, কামদ, মৎস্য, পাঞ্চালের রাজপুত্র, শাল্ব, শিশুপাল, কারুষার রাজা দন্ডবক্র(শিশুপালের ভাই), জয়দ্রথ, শল্য, মদ্র, কৌশল, রাজচক্রবর্তী জরাসন্ধ মহাতেজা প্রমুখ আশি সহস্র রাজা স্বয়ম্বরে এলেন। 
রাজা ভগদত্ত রাজাদের জানালেন উচ্চে মৎস লক্ষ্য স্থাপন করা হল। এই রইল ধনুর্বাণ। যিনি লক্ষ্যভেদ করবেন তিনিই কন্যা ভানুমতীকে পাবেন। 
ভানুমতীকে সভায় আসতে বললেন। সূর্যের প্রকাশে আঁধার যেমন ঘোচে, তেমনি ভানুমতীর প্রকাশ ঘটল। তাকে দেখে সকল রাজা মোহিত হলেন। ষোড়শ কলায় যেন চন্দ্রের শোভা। 
একে একে রাজারা উঠে ধনুকে গুণ পরাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু কারো শক্তিতে কুলালো না। মহারাজ জরাসন্ধ ধনুক নিয়ে বহু পরিশ্রমে তাকে নুইয়ে গুণ পরালেন। শেষে বাণ লাগিয়ে লক্ষ্য স্থির করেও লক্ষ্যভেদ করতে পারলেন না। লক্ষ্য স্পর্শ করে বাণ মাটিতে পরল। জরাসন্ধ ধনুক বাণ ফেলে দিলেন। এভাবে কোন রাজাই লক্ষ্যভেদ করতে পারলেন না। 

সকল রাজাদের বিমুখ দেখে চিন্তিত প্রাগ্‌জ্যোতিষের রাজা ভগদত্ত যোড়হাতে রাজাদের বলেন – কেউই আপনারা লক্ষ্যভেদ করতে পারলেন না এখন আপনারাই বলুন আমি কন্যার বিবাহ কিভাবে দেব। 

রাজারা বলেন – আমাদের শক্তিতে এ লক্ষ্যভেদ সম্ভব হল না। যার শক্তি আছে সেই এই কন্যাকে পাবে। অন্যরা কিছু বলতে পারবে না। 

এই শুনে ভগদত্ত বলেন – সভায় যত অস্ত্রধারী আছেন-ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র তাদের মধ্যে যিনিই লক্ষ্যভেদে সক্ষম হবেন কন্যা ভানুমতী তাঁরই হবেন। 

মহারাজ বারবার সকলকে অনুরোধ করলে মহাবীর বৈকর্ত্তন কর্ণ উঠে এলেন। ধনুক আকর্ণ টেনে টঙ্কার ধ্বনি দিলেন। লক্ষ্যের উদ্দ্যেশে বাণ স্থাপন করে মহা পরাক্রমে তা ছুঁড়লেন। একবাণে মৎসচক্রচ্ছেদ করে ফেললেন। দেখে ভানুমতী খুশি হলেন। তিনি কর্ণের গলায় মালা দিতে গেলেন। কিন্তু কর্ণ পিছু হটে গলা সরিয়ে নিলেন। দেখে অন্য রাজারা অবাক হলেন। 

রাজা জরাসন্ধও ভানুমতীকে নিষেধ করতে লাগলেন। দেখে সূর্যপুত্র কর্ণ রেগে গেলেন। কর্ণ বলেন – আমি লক্ষ্যভেদ করাতে ভানুমতী আমায় মালা দিতে এলেন। বন্ধুর জন্য আমি তাকে বারণ করলাম। কিন্তু তুমি কোন সাহসে তাকে নিবারণ কর! 

জরাসন্ধ বলেন – আমিও এই প্রসাদের অর্ধ ভাগীদার। আমি ঐ ধনুকে গুণ পরিয়েছিলাম। তাই তোমার প্রসাদের অর্ধেক আমারও প্রাপ্য। এই বলে তিনি অন্য রাজাদের সমর্থন চাইতে লাগলেন। 

রাজারাও তাকে সমর্থন করে বলেন – ধনুকে গুণদাতারও অর্ধেক ভাগ আছে। ভানুমতীর স্বামিত্ব তাই দুজনেরই। এখন এই দুজনের মধ্যে যিনি বলবান তিনিই কন্যা ভানুমতীকে পাবেন। 

শুনে কর্ণ জরাসন্ধকে বলেন – রাজন, মিথ্যে যুদ্ধের আহ্বান করলেন। বহু শক্তি প্রয়োগ করে ধনুক নোয়ালেন। কিন্তু লক্ষ্যভেদ করতে পারলেন না। এখন কন্যার লোভে অকারণে যুদ্ধ করতে চাইছেন। এর উচিত ফল আমার হাতেই আপনি ভোগ করবেন। এই ধনুকে শতবার আমি গুণ দিতে পারি। কিন্তু লক্ষ্যভেদে একবারও শক্তি আপনার দ্বারা সম্ভব হয়নি। আবার লক্ষ্য স্থানে রাখা হোক। দেখুন কত সহজে আমি ধনুকে গুণ পরিয়ে লক্ষ্যভেদ করি। না হয় আপনার ইচ্ছে হলে আসুন যুদ্ধ করি। 

এত শুনে রাজা জরাসন্ধ কর্ণের দিকে তেড়ে গেলেন। দুজনে দুজনকে নানা অস্ত্রে আঘাত করতে লাগলেন। কর্ণ নানা অস্ত্র বর্ষণ করলেন। বৃহদ্রুথের পুত্র জরাসন্ধ তা নিবারন করতে লাগলেন। প্রাণপণে দুজনে ঘোর যুদ্ধে মেতে উঠলেন। মগধকুমার জরাসন্ধ ধনুক ফেলে গদা তুলে নিলেন। তিনি গদা যুদ্ধে বেশি পারদর্শি। তাঁর গদার আঘাতে কর্ণের রথ চূর্ণ হল। সারথি, তুরঙ্গ(ঘোড়া), রথ- সব নষ্ট হলে বীর কর্ণ লাফ দিয়ে মাটিতে নেমে এলেন। আবার আরেক রথে উঠলে সে রথও জরাসন্ধ চূর্ণ করলেন। বীর জরাসন্ধ মাথার উপর তাঁর গদা ঘোরাতে ঘোরাতে মার মার বলে ডাক ছারেন। কর্ণ বৃষ্টির মত বাণ মারতে থাকেন। গদায় লেগে তা মাটিতে পরে। এভাবে অনেক্ষণ যুদ্ধ হয়। রেগে কর্ণ দিব্যঅস্ত্র প্রয়োগ করলে জরাসন্ধের গদা খন্ড খন্ড হয়ে কেটে পরে যায়। তিনি আরেক গদা তুলে আক্রমণ করেন। কর্ণ সেটিও কেটে দেন। এভাবে জরাসন্ধের সবকটি গদা একে একে কাটা পরলে তিনি নিরস্ত্র হয়ে পরেন। শেষে মগধকুমার জরাসন্ধ কর্ণকে বলেন- আমি অস্ত্রহীন, অথচ তুমি অস্ত্রধারী। এখন তুমিও অস্ত্র ত্যাগ করে নিচে এসে আমার সাথে বাহুযুদ্ধ কর। শুনে কর্ণ তীর ধনুক ত্যাগ করে মাটিতে নেমে এলেন। এবার কর্ণ ও জরাসন্ধের বাহুযুদ্ধ শুরু হল। মুন্ডে মুন্ডে, বাহুতে বাহুতে, বুকে বুক ঠেলে, পায়ে পায়ে জড়িয়ে গড়াগড়ি দিয়ে সাঙ্ঘাতিক মল্ল যুদ্ধ হতে থাকে। পদাঘাতে, করাঘাতে, মুষ্টি প্রহারে দুজনের শরীরে দুজন আঘাত করতে থাকেন। মাথার মুকুট উড়ে গেল, রত্ন কন্ঠহার ছিঁড়ে গড়াগড়ি গেল। দুজনের সেই যুদ্ধে যেন বিরাম নেই। এমন যুদ্ধ পূর্বে সীতার জন্য রাম ও রাবণের হয়েছিল। কর্ণ ও জরাসন্ধকে দেখে মনে হল বসন্তকালে হস্তিনীর জন্য যেন দুই মত্ত দাঁতাল হস্তী মহারণে মেতেছে। সূর্যপুত্র কর্ণ, সূর্যের মতই তাঁর তেজ। তাঁর ক্রোধ মূর্তি যেন কালান্তক যমের রূপ। বাহুবলে তিনি জরাসন্ধকে তুলে মাটিতে আছড়ে ফেলেন। বুকে হাঁটু দিয়ে তাঁর গলা চেপে ধরেন। 

জরাসন্ধের বিপদ বুঝে অন্য রাজারা এগিয়ে এসে হাহাকার করে কর্ণকে নিবৃত্ত করেন। হেরে অপমানিত হয়ে মগধরাজ জরাসন্ধ মনের দুঃখে নিজের দেশে ফিরে গেলেন। তখন ভানুমতীকে নিয়ে কর্ণ বন্ধু দুর্যোধনের কাছে গেলেন। আনন্দিত হয়ে দুই বন্ধু পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলেন। এভাবে ভানুমতীর সাথে দুর্যোধনের বিবাহ হল। ভানুমতীকে নিয়ে তারা নিজ দেশে গেলেন। 
মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীদাস কহে সদা শুনে পূণ্যবান। 
.................................... 

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers