Blog Archive

Tuesday, February 10, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৭৫

[পূর্বকথা –পাণ্ডবরা দেবল ঋষির কনিষ্ঠ ভাই ধৌম্যকে পৌরোহিত্যে বরণ করে নিলেন এবং পাঞ্চালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। সেখানে দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরের আয়োজন চলছে। দ্রুপদের আমন্ত্রণে সকল দেশের রাজারা যেমন এলেন, দেবতারাও উপস্থিত হলেন...] 

দ্রৌপদীর সভায় আগমনঃ 
 

পাঞ্চালরাজ্যে অনেকদিন ধরে নৃত্য, গীত ও ধনরত্নদান চলতে লাগলো। তারপর ষোড়শদিন এক লক্ষ রাজা যখন সভায় বসলেন তখন রাজা দ্রুপদ ধাত্রীদের আজ্ঞা দিলেন দ্রৌপদীকে সাজিয়ে সভায় আনার জন্য। রাজার আজ্ঞা পেয়ে ধাত্রীরা নানা অলঙ্কারে দ্রৌপদীকে সাজালো। নানা পুষ্পে তাকে সাজান হল যেন ষোড়শকলায় ব্রাহ্মণ ও রাজাদের মন জয় করতে পারেন। দ্রৌপদীর পুরোহিত মন্ত্রধ্বনি পড়তে লাগলেন। যজ্ঞ ও পূজা করে তিনি সভার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। সভার মাঝে যখন দ্রৌপদী উপস্থিত হলেন, তাকে দেখে রাজারা যেন মূর্ছিত হল। সকলের অন্তরের কামাগ্নি প্রজ্বলিত হল, সকলে অচেতন হলেন। সকলে পুতুলের মত স্থির হয়ে বসে, কেউ কেউ সেখানেই ঢলে পরল, কেউবা অজ্ঞান হয়ে গড়াগড়ি দিল। কেউবা সচেতন হয়ে আর মাথা তুলে চাইতে পারে না। কেউ কেউ আবার নিজের গুণকীর্তন শুরু করে দিল। সকলে মনে মনে ভাবে ধন্য এ জীবন যাকে দেখলাম এই রূপে। এখন কোন রাজা এ কন্যার অন্তরের রাজা হন –তাই দেখার। 
.................................... 

দ্রৌপদীর রূপ-বর্ণনাঃ 
 

দ্রৌপদী - পূর্ণচন্দ্রের চেয়েও শ্রেষ্ঠ, বিকশিত পদ্মের মত মুখ, গজমতি(হাতির মাথার মুক্তা-প্রবাদ) অলঙ্কারে ভূষিতা, তিলফুলের মত নাসা- দেখে মুনির মনও সুখি হয়। চোখদুটি এমন সুন্দর যে দেখে মাছ ও হরিণ দুইই লজ্জায় বনে পালায়। এমন সুচারু ভুরুলতা দেখে মদনের শরধনুও ব্যাথা পায়। পলার মত রক্তবর্ণের ঠোঁট, কপালটিও নবোদিত সূর্যের মত আরক্ত। মাথায় ঘন কালো মেঘপুঞ্জের(কাদম্বিনী) মত কেশ, মধ্যে স্থির বিদ্যুতের(সৌদামিনী) রেখার মত সিঁথিটি। (চাঁচর)কুঞ্চিত কেশ কপালে এসে পরেছে। বিদ্যুতের মত কানের স্বর্ণ কুন্ডলদুটি চাঁদের মত সুন্দর মুখের আড়ালে ঝিলিক মারছে। স্তনদুটি দেখলে লজ্জায় ডালিমও হৃদয় ফেটে পড়ে যাবে। কন্ঠ দেখে শঙ্খও অগাধ সমুদ্রের মাঝে প্রবেশ করবে। পদ্মের নালের মত সুন্দর দুটি বাহু সর্পকে লজ্জায় বিলে প্রবেশ করাবে। কোমর বা কটি এত সরু যে হস্তি তা দেখে লজ্জায় বনে পালাবে। করতল কোকনদের(লালপদ্ম) মত কোমল ও সুন্দর। নখগুলি যেন চন্দ্রকে ধারণ করেছে। সেই হাতে সোনার কঙ্কণ সব সময় ঝন্‌ঝন্‌ করে বাজছে। চরনের নুপুরদুটি যেন হংস। সুন্দর কোমরটিও সোনার অলঙ্কারে জরানো। কদলীবৃক্ষের মত সুপুষ্ট ও সুন্দর উরু দেখে হাতিরও নিন্দা হবে। পেটটি ছোট ও হরিণের মত টানটান, নীতম্ব যেন যুগল ক্ষিতি(পৃথিবী)। নীলবর্ণের সুকোমল নির্মল শরীরটি যেন পদ্মে গঠিত। অলঙ্কারের ভারে কোমল সুন্দর দেহটি যেন একটু নত, যা দেখে চিত্ত মোহিত হয়। পদ্মের মত মুখশ্রী, পদ্মের মতই নয়ন যুগল, পদ্মকেও লাঞ্ছিত করে এত সুন্দর দুটি গাল। পদ্মেরডাটির মত দুই বাহু, তাকে যেন সুন্দর মিষ্টি পদ্মের গন্ধ ঘিরে আছে যা যোজন দুরেও ছরিয়ে যাচ্ছে এবং মৌমাছিরা সেই গন্ধে বিভোর হয়ে চারদিকে ঘুরে বেরাচ্ছে। কুরুকুল ধ্বংসের জন্যই লক্ষ্মীর অংশে এই কমলে সৃজিতা নারীর জন্ম। কাশীনাথ যিনি কমলাকান্তের পুত্র তিনিও সেই লক্ষ্মীদেবীকে প্রণাম জানান। 
.................................... 

রাজাদিগের লক্ষ্যভেদে উদ্যোগঃ 
 

দ্রৌপদীর রূপ দেখে রাজারা মোহিত হলেন। দ্রৌপদী সভার মাঝে এলে সকলে দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন। হুড়াহুড়ি করে সবাই আগে লক্ষ্য বিদ্ধ করতে চায়। বন্ধুদের মধ্যেও বিবাদ শুরু হল। সকলে ধনুককে ঘিরে দাঁড়িয়ে পরল। 
তখন ক্ষত্রিয়কুলের মহাতেজা রাজচক্রবর্তী মগধরাজ জরাসন্ধ ধনুক ঝাঁকিয়ে তুললেন এবং গুণ পরানোর জন্য ধনুক নোয়াতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু ধনুকে বেশি ভর দিয়ে ফেলায় ধনুক তাকে বহু দূরে আছড়ে ফেললে রাজা মূর্ছা গেলেন। 
তখন দুর্যোধন দম্ভ করে এগিয়ে এসে ধনুক ধরে হাঁটু মুড়ে বসে গুণ পরাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুতেই ধনুককে নোয়াতে পারলেন না। তিনি আরো বল প্রয়োগ করতে লাগলেন। মুখে রক্ত উঠে এল, শরীর কাঁপতে লাগলো। শেষে ধনুকের আঘাতে ভূপতিত হলেন। 
তখন মৎসরাজ বিরাট এসে বহু কষ্টে ঠেলাঠেলি করে ধনুকটি নিলেন। কিন্তু তিনি তা তুলতেও পারলেন না, আবার ছাড়তেও পারছিলেন না। 
তা দেখে হেসে সুশর্মা যিনি ত্রিগর্তদেশের রাজা ধনুক কেড়ে নিয়ে বলেন –সুন্দরী কন্যা দেখে বৃদ্ধ বয়সে কি লজ্জার মাথা খেলেন, রাজন! লক্ষ্যবেঁধার ছলে সমাজ হাসালেন। ধনুক তোলার শক্তি নেই, আবার লক্ষ্য বেঁধার ইচ্ছা! এই মূর্খ মৎসরাজকে সকলে ধর। এত বলে তিনি দ্রুত ধনুক হাতে তুলে নিলেন। 
তা দেখে বীর কীচক, যিনি বিরাটরাজার সেনাপতি ও শ্যালক, রাগে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে এসে ত্রিগর্তরাজ সুশর্মাকে ঠেলে ফেলে চাপড় মেরে ধনুক কেড়ে নিলেন। পায়ে চেপে ধরে ধনুকে গুণ দিতে চাইলেন। কিন্তু ধনুকের ধাক্কায় বহুদুর পরে মৃতপ্রায় হলেন। 
এভাবে মত্ত হস্তীর বলধারী পরাক্রমী দশ সহস্র বীর কেউই ধনুকে গুণ পরাতে সক্ষম হলেন না। 
চেদিরাজ শিশুপালও(কৃষ্ণের পিসতুতোভাই, দমঘোষের পুত্র) সভার মাঝে বড়ই লজ্জিত হলেন। প্রাণপণে তিনি ধনুক নোয়াতে চেষ্টা করলেন। দেহ অবস হয়ে এলো কিন্তু ধনুক হেললো না। ধনুকের হুল চিবুকে লেগে তিনি বহুদুরে রাজাদের মধ্যে উল্টে পরলেন। মুকুট ভেঙে গেল, শরীর অবশ, মৃতপ্রায় রাজা হতভম্ব হয়ে রইলেন। 
তারপর একে একে অন্য রাজারা-বিদর্ভের রাজপুত্র রুক্মী, প্রাগ্‌জ্যোতিষের রাজা ভগদত্ত, মদ্ররাজ[বর্তমানে হিমালয়ের উত্তরাঞ্চল, জম্বুকাশ্মীরের অংশ] শল্য, রাজপুতানার শাল্ব, বাহ্লীক, কলিঙ্গ, কাশ্ম, চন্দ্রসেন, মদ্রসেন, পৌরব, সত্যসেন, সুষেণ, রোহিত প্রমুখ বলবন্ত, কুলবন্ত ক্ষত্রিয় প্রধানরা সবাই একে একে ধনুক নোয়াতে বিফল হলেন। সকলে প্রাণপণে দুর্জয় মহাধনু তোলার চেষ্টা করলেন কিন্তু গুণ কেউই পরাতে পারলেন না। ধনুক একদিকে রাজারা অন্যদিকে গড়াগড়ি যান। মাথা থেকে মুকুট গড়িয়ে পড়ে, গলায় মনিমুক্তার হার ছিঁড়ে গড়াগড়ি খায়। কারো হাত ভাঙ্গে, কারো বা ঘাড়, কাঁধ, নাক। কারো বা মুখ ঝলকে ঝলকে রক্ত উঠে আসে। কেউ বা হাহাকার করে ভূমিতে পরে। 

বড় বড় রাজাদের এমন অপমানিত হতে দেখে অন্যেরা আর এগোতে সাহস পেল না। শুরুতে কে প্রথমে যাবেন তাঁর প্রতিযোগীতা হচ্ছিল, এখন লজ্জায় কেউ মুখ দেখাতে পারলেন না। অনেকে উঠে সভায় বসলেন বটে কিন্তু লজ্জায় অধোমুখে ধনুকের দিকে পিছন ফিরে রইলেন। সকল ক্ষত্রিয় রাজারা বুঝে গেলেন এ অজেয় ধনুক, কারো পক্ষে লক্ষ্যভেদ সম্ভব নয়। 

সব রাজারা যখন হার মেনে নিলেন তখন পাঞ্চালরাজ করযোড়ে বললেন- শুনুন, রাজনরা! স্বয়ম্বর করে আমি নিজেই লজ্জা পেলাম। যাদের নিমন্ত্রণ করে আনলাম সেই রাজারা প্রাণপাত করেও কার্য্যসিদ্ধি করতে পারলেন না। 
সকলে বলেন – রাজা! আপনাকে আমরাও বুঝতে পারলাম না। এমন ধনুক আমরা কেউ কখনও দেখিনি। এর আগেও আমরা অনেক স্থানে লক্ষ্যভেদ করে কন্যা গ্রহণ করেছি। কিন্তু এমন ধনুক কোথাও দেখি নি। ধনুকের আঘাতে রাজারা মুর্ছা গেল, লক্ষ্যভেদ তো দুরের কথা, কেউ তাতে গুণও পরাতে পারলাম না! আমাদের সকলকে বিড়ম্বিত করতেই আপনি এমন চাতুরী করেছেন। অনেক ধনুক দেখা হয়েছে কিন্তু একি! এমন ধনুক কেউ দেখেনি, এমন ধনুকের কথাও কেউ শোনেনি। কিছুকাল পূর্বেও মদ্ররাজ বৃহদসেনা তাঁর কন্যা লক্ষণার স্বয়ম্বর করেন। যোজন উঁচুতে রাধাচক্র বসান। তাতেও কেউ কেউ গুণ পরায়। শেষে বাসুদেব কৃষ্ণ লক্ষ্যভেদ করে লক্ষণাকে লাভ করেন। রাজা ভগদত্ত তাঁর কন্যা ভানুমতীর বিবাহও এভাবেই দেন। সেই ধনুকও এ ধনুকের সমান প্রায়। কিন্তু সে ধনুতেও গুণ দেওয়া গেছিল। কর্ণ লক্ষ্যভেদ করে কন্যাকে দুর্যোধনের হাতে দেন। 

জন্মেজয় আবার মুনিকে জিজ্ঞেস করলেন – মুনি, কর্ণ কি ভাবে লক্ষ্যভেদ করলেন সে সম্পর্কে বলুন। ভানুমতীর স্বয়ম্বরের কাহিনীও শুনতে ইচ্ছে করছে। কোন্‌ কোন্‌ রাজারা সেখানে গিয়েছিলেন। 

মহাভারতের কথা অমৃত লহরী, কাশীরাম কহেন এবং যা শুনলে সংসার সমুদ্র সহজে পার হওয়া যায়। 
.................................... 

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers