Blog Archive

Sunday, January 31, 2016

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১২২

[পূর্বকথা - সুভদ্রাকে নিয়ে অর্জ্জুন ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরলেন..তাদের সন্তান হল-অভিমন্যু ....এছাড়া দ্রৌপদীরও পাঁচপুত্র হল পঞ্চপাণ্ডব থেকে –প্রতিবিন্ধ্য, সুতসোম, শ্রুতকর্মা, শতানীক ও শ্রুতসেন........—আদিপর্ব সমাপ্ত—

সভাপর্বঃ



মহাভারত শ্রবণের ফলশ্রুতিঃ 

কাশিরাম দাস মহানন্দে এই বেদার্ণব(বেদ-সমুদ্র) মন্থন করে জগতজনকে আনন্দ দান করেন। ত্রৈলোক্যে এর মহিমার সমান কমই আছে। মহামুনি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস মূল মহাভারত-চন্দ্রিমা অতি যত্নে রচনা করেছিলেন। জগৎ সংসারে যা ঘটে তাই এখানে পাওয়া যায়। বহু দান-ধ্যান করে, বহু শ্রম করে যে পুণ্য মেলে তার অধিক ফল মহাভারত শ্রবণে মেলে। মহাভারত তুল্য আর কিছু এ ত্রিভুবনে নেই।

ময়দানব-কর্ত্তৄক সভা-নির্ম্মাণঃ



জন্মেজয় পুনরায় বৈশম্পায়নের কাছে ময়দানব, কৃষ্ণ ও অর্জুনের পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে জানতে চাইলেন। 

মুনি বলেন –অগ্নি সত্য পালনের বিবরণ শুনে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির পরম আনন্দিত হলেন। তিনি ব্রাহ্মণদের অনেক ধেনু ও স্বর্ণ দান করলেন। সেই সাথে ময়দানবকেও অনেক সম্মান দেখালেন। 

তৃতীয়পান্ডব অর্জুনের এই মহাকীর্তি সংসারে রাষ্ট্র হলে রিপুরা(শত্রুরা)ও চমৎকৃত হল। এভাবে পঞ্চপাণ্ডব মহাসুখে সর্বদা যজ্ঞ-দান-ধ্যান-মহোৎসবে রাজ্য শাসন করতে লাগলেন। 

মুনি বলেন –হে পরীক্ষিত নন্দন এবার মহাভারতের সভাপর্বের বিচিত্র কথা শুনুন। 
[পান্ডু+কুন্তী=অর্জুন+সুভদ্রা=অভিমন্যু+উত্তরা=পরীক্ষিত+মদ্রাবতী=জন্মেজয়+বপুষ্টমা] 

অগ্নির হাত থেকে ময়দানব রক্ষা পেয়ে কৃতার্থ হয়ে শ্রীকৃষ্ণ ও পার্থের সামনে যোড়হাতে বিনয়ের সাথে বলেন –সুদর্শনচক্রকে তিনলোক ভয় পায়। সেই চক্রের হাত থেকে আমায় উদ্ধার করলেন। আবার প্রচন্ড অগ্নির হাত থেকেও আমায় বাঁচালেন। আজ থেকে আমার প্রাণ আপনাদের কাছে বিক্রীত হল। আমি আপনাদের জন্য কি করতে পারি আজ্ঞা করুন। আমার হৃদয় ব্যাকুল কিছু করার জন্য। 

অর্জুন বলেন –হে দানব ঈশ্বর! আপনি চিরদিন আমার বন্ধু থাকুন। এই আমার মনের ইচ্ছের, আমার আর কিছু চাই না। 

ময় বলেন –যতক্ষণ না আপনার জন্য কিছু করতে পারছি ততক্ষণ আমার মন শান্ত হবে না। আমি দানবকুল শ্রেষ্ঠ, দানবকুলের বিশ্বকর্মা। আপনি যা আজ্ঞা করবেন আমি তাই করে দেব আপনার জন্য। 

পার্থ বলেন –আমি কিছুই চাই না। আপনি দেব দামোদর কৃষ্ণের জন্য কিছু করে তাকে প্রীত করুন। 

এবার কৃষ্ণের সামনে যোড়হাতে গিয়ে তাঁর মনের ইচ্ছে জানতে চাইলেন। 
অনেক চিন্তা করে কৃষ্ণ বলেন –তুমি এমন এক দিব্য সভা নির্মাণ কর যা আগে কেউ দেখে নি। সুরাসুরও যা দেখে অবাক হবে। 

কৃষ্ণের আদেশে ময় খুশি হয়ে দ্রুত সভা নির্মাণ করতে চললেন। তিনি কনক নিরমিত এক বিচিত্র সভা নির্মাণ করতে লাগলেন। সে যেন এক নানা গুণযুক্ত এক দেবস্থান। যা চারদিকে দশ সহস্র ক্রোশ বিস্তৃত। সুরাসুর, নাগ, নর কেউই এমন আগে দেখে নি। 

এই বিচিত্র সভা রচনা করে ময় কৃষ্ণকে জানালেন। যুধিষ্ঠির, কৃষ্ণ, পার্থ সবাই সভা দেখে চমৎকৃত হলেন এবং ময়দানবের অনেক প্রশংসা করলেন। শুভক্ষণে মহোৎসবে ব্রাহ্মণদের পায়সান্ন ভোজন করিয়ে নানা রত্ন-রজত-কাঞ্চন দান করে পাণ্ডবরা সপরিবারে সভায় প্রবেশ করলেন। 
বেশ কিছুদিন কৃষ্ণও তাদের সাথে থাকলেন। পরে দ্বারকায় পিতার কাছে তার যেতে ইচ্ছে করল। তিনি পিতৃস্বসা(পিসি) কুন্তীর কাছে বিদায় দিতে গেলেন। ভোজকন্যা তাকে স্নেহালিঙ্গন করলেন। ভগিনী সুভদ্রার সাথে দেখা করলেন। সুভদ্রা কাঁদতে লাগলেন। 
বোনের চোখে জল দেখে রুক্মিণীকান্ত-কৃষ্ণ ভগিনীকে প্রবোধ দেন, বলেন –শাশুড়ির সেবা করবে। দ্রৌপদীকে সর্বদা সম্মান জানাবে। 
সুভদ্রা কাঁদতে কাঁদতে দাদাকে বিদায় জানালেন। 

এরপর গদাধর কৃষ্ণ দ্রৌপদীর কাছে গিয়ে বলেন –ভগিনী সুভদ্রা আমার প্রাণের অধিক। আপনি তাকে সর্বদা স্নেহ করবেন এই আশা রাখি। 

এরপর তিনি ধৌম্য পুরোহিতকে নিয়ে যুধিষ্ঠিরের কাছে উপস্থিত হয়ে নমস্কার করে বলেন –আজ্ঞা করুন, এবার নিজ গৃহে যাই। শুনে ধর্মপুত্র বিষন্ন হলেন, সজল নয়নে কৃষ্ণকে বিদায়ালিঙ্গন করেন। ভীমার্জুনের সাথে কৃষ্ণ কোলাকুলি করেন। মাদ্রীপুত্রেরা এগিয়ে এসে কৃষ্ণকে প্রণাম জানান। 
নক্ষত্র গণনা করে বেদ-বিধি মত শুভক্ষণ দেখে ব্রাহ্মণরা মঙ্গলধ্বনি উচ্চারণ করতে থাকেন। সারথি দারুক গরুড়ধ্বজ সাজিয়ে গোবিন্দের সামনে রথ নিয়ে উপস্থিত হল। 

যাঁর নাম নিয়ে সবাই যাত্রা শুরু করে, তিনিই আজ চারদিক শুভ করে যাত্রা শুরু করলেন। 
কৃষ্ণকে এগিয়ে দিতে স্নেহবশে পঞ্চপাণ্ডবও খগপতিধ্বজে উঠে বসলেন। দারুক রথ চালাল। 

কয়েক যোজন যাওয়ার পর শ্রীপতি কৃষ্ণ ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের হাত ধরে অনুরোধ করেন –হে মহারাজ! এবার নিজ গৃহে ফিরে যান। আমাকে সর্বদা দয়া করে হৃদয়ে রাখবেন। 

কৃষ্ণ সজল নয়নে পার্থকে আলিঙ্গন করেন। অনেক কষ্টে পঞ্চপাণ্ডবকে কৃষ্ণ ফেরালেন। তাদের আত্মা, মন সবই কৃষ্ণের সাথে গেল, কেবল দেহই রইল। বিরস বদনে তারা সভায় ফিরলেন। 
এভাবে দ্বারকা-রমণ কৃষ্ণ দ্বারকায় ফিরলেন। 

এদিকে ময়দানব নিজ কর্মে খুশি হলেন না। তিনি ধনঞ্জয়ের কাছে এসে বলেন –আমার মনের মত সভা এখনও সম্পূর্ণ হয় নি। আপনি আজ্ঞা করুন আমি মৈনাক পর্বতে যেতে চাই। কৈলাস পর্বতের উত্তরে হিমালয়ের কাছে দানবরাজ বৃষপর্বা সেখানে বসতি স্থাপন করেন। তার সভা আমি পূর্বে নির্মাণ করেছি। সেখানে নানা রত্ন মনি মাণিক্য সঞ্চিত রয়েছে। ত্রিলোকের যত দিব্য রত্ন ছিল সব দিয়ে সে গৃহ পূর্ণ হয়ে আছে। কৌমোদকী গদার[বিষ্ণুর গদা, কুমোদক-বিষ্ণু] সমতুল্য যে গদাটি আছে সেটি বীর বৃকোদর ভীমের যোগ্য। আপনার হাতের গান্ডীব ধনুকের সমান সে গদা, যা বিন্দুসরোবর মাঝে আছে। এছাড়া বরুণ(জলদেবতা)দেবকে হারিয়ে বৃষপর্বা দৈত্যেশ্বর দেবদত্ত শঙ্খ পেয়েছিলেন, যা অতি মনোহর। তার শব্দ শুনে রিপুরা(শত্রুরা) নিজ দর্প ত্যাগ করে। সে শঙ্খ এনে আমি আপনার হাতে সমর্পণ করতে চাই। এ সবই সেই বিন্দুসরোবর মাঝে আছে। আজ্ঞা করুন এখনই গিয়ে সব আপনার জন্য আনি। 

অর্জুন বলেন –আপনার যখন মন চাইছে, আপনি তাই করুন। 

আজ্ঞা পেয়ে দানবরাজ ময় কৈলাসের উত্তরে মৈনাকের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। ভাগীরথী(গঙ্গা)র জন্য রাজা ভগীরথ এখানেই তপস্যা করেন বহুকাল। নরনারায়ণ, শিব, যম, পুরন্দর ইন্দ্রও এখানে যজ্ঞ করে গেছেন। এখানেই স্রষ্টা ব্রহ্মা বসে সৃষ্টির কল্পনা করেছিলেন। সেই পবিত্রস্থানে ময়দানব পৌছালেন। তিনি দেবদত্ত শঙ্খ, গদা ও বর্ণনাতীত ধন রত্ন নিয়ে ফিরে এলেন। ভীমকে গদা ও অর্জুনকে গদা উপহার দিলেন। ভীমার্জুন অতি প্রীত হলেন। 
এরপর ময় সভা সাজাতে লাগলেন। কনক-বৈদুর্য্যমণি(নীলকান্তমণি), মুক্তা, প্রবাল, মরকত(সবুজ পান্না), স্ফটিক, রজত চালচিত্র, স্ফটিকের স্তম্ভ তাতে মণি হীরার কাজ, প্রতি কক্ষে মণিমুক্তার ঝার, বসবার স্থানগুলিও রত্ন দিয়ে সাজান হল। বেদীগুলি বিচিত্র সাজে উঠল। চারদিক নানা জাতের ফুলফলের বৃক্ষে সাজান হল। ভ্রমররা মকরন্দ(পুষ্পমধু) লোভে চারদিকে গুনগুন করতে লাগল। এভাবে ময়দানব ত্রিলোক বিখ্যাত দিব্য মণিময় সভা নির্মাণ করলেন, যার দীপ্তিতে চন্দ্রসূর্যের প্রভাও পরাস্ত হল। বিজ্ঞলোকজন অনেক বিচার করেও তার কোন খুঁত পেল না। 

একমাসে এই সভা রচনা করে ময় কুন্তীপুত্রদের কাছে তা নিবেদন করলেন। সভা দেখে রাজা যুধিষ্ঠির অত্যন্ত খুশি হয়ে সকলকে তা দেখাতে আনলেন। এমন সভা দেখে পাঁচভাই আনন্দের সাগরে ভাসতে লাগলেন। ঘি, মধু মিশ্রিত পায়স, ফলমূল, বরাহ ও হরিণের মাংস, তিল মিশ্রিত অন্ন প্রভৃতি বিবিধ ভোজ্য দিয়ে দশ লক্ষ ব্রাহ্মণের ভোজন করান হল। ভোজনান্তে দ্বিজরা পরম উল্লাসে স্বস্তি ধ্বনি তুলে আশীর্বাদ করতে লাগল। অনেক মুনিরা এলেন এবং ধর্মপুত্রের প্রতি প্রীত হয়ে সভাতেই রয়ে গেলেন। 
এরা হলেন-অসিত, দেবল, সত্য, সর্পমালী ঋষি, মহাশিরা, অর্বাবসু, সুমিত্র তপস্বী, মৈত্রেয়, শুনক, বলি, সুমন্ত, জৈমিনি, পৈল, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন, জাতুকর্ণ, শিখাবান, পৈঙ্গ, অপ্সু-হৌম্য, কৌশিক, মান্তব্য, মার্কণ্ডেয়, বক, ধৌম্য, জঙ্ঘাবন্ধু, রৈভ্য, কোপবেগ, পরাশর, পারিজাত, সত্যপাল, শাণ্ডিল্য শ্রেষ্ঠ, গালব, কৌন্ডিন্য, সনাতন, বভ্রুমালী, বরাহ, সাবর্ণ, ভৃগু, কালাপ, ত্রৈবলি প্রমুখ অনেক ঋষি, যাদের নাম বলে শেষ করা যায় না। এঁরা সবাই সত্যবাদী ও জিতেন্দ্রিয়। 
এঁনারা যুধিষ্ঠিরের সভায় পুরান ও ধর্মকথা নিয়ে নানা আলোচনায় ব্যস্ত থাকেন। 

পৃথিবীর মুখ্য যত ক্ষত্রিয় রাজা, তারাও এই অপূর্ব সভা দেখতে এলেন-মুক্তকেতু, বিবর্দ্ধন, কুন্তী, উগ্রসেন, সুধর্মা, সুকর্মা, কৃতবর্মা, জয়সেন, অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, মগধের অধিপতি, সুমিত্র, সুমনা, ভোজ, সুশর্মা, বসুদান, চেকিতান, কেতুমান, জয়ন্ত, সুষেণ, মৎস্যরাজ, ভীষ্মক, কৈকয়, শিশুপাল, সুমিত্র, যবনপতি, শল্য, বৃষ্ণি, ভোজ, যদুবংশীয় সকল কুমার প্রমুখ অনেক রাজা, গুণে শেষ হয় না। 

অনেকে অর্জুনের কাছে অস্ত্রশিক্ষার জন্য জিতেন্দ্রিয় হয়ে সর্বক্ষণ সেখানে অনুশীলনে রত হল। 
গন্ধর্বরাজ চিত্রসেন তার অপ্সর কিন্নরদের নিয়ে নৃত্যগীত বাদ্যরসে পাণ্ডবদের সেবা করতে লাগলেন। 

সব দেখে মনে হয় যেন বিরিঞ্চি ব্রহ্মাকে ইন্দ্রাদি দেবতারা সেবা করছেন। 

এভাবে পঞ্চপাণ্ডব মনের সুখে সভাকার্য সম্পাদন করতে থাকেন। 
......................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers