Blog Archive

Wednesday, June 9, 2010

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৩


সমুদ্র-মন্থনঃ

সৌতি বলেন -

গদাধর বিষ্ণু প্রথম ব্রহ্মাকে বললেন দেবাসুরদের দিয়ে সমুদ্র মন্থন করতে। সমুদ্রে মন্থনের ফলে যে সুধা বা অমৃত উঠবে তা পান করে দেবতারা অমর হবেন। মন্দর পর্বত দিয়েই এই মন্থন করা হবে।

বিষ্ণুর আজ্ঞায় দেবতারা মন্দর পর্বতের কাছে গেলেন। কিন্তু এই বিশাল পর্বতকে তারা উপ্‌রাতে পারলেন না। বিষ্ণুর সাহায্যেই মন্দরকে সমুদ্রে আনা হল।

বরুণকে সকলে অনুরোধ করলেন মন্দর পর্বতকে বহন করার জন্য। কিন্তু বরুণ রাজি হলেন না। তিনি বললেন তাঁর মধ্যেই একটি মহাশক্তিমান কচ্ছপ আছে সেই কেবল মন্দরকে বহন করতে পারে। দেবতারা তখন সেই কচ্ছপের আরাধনা করলেন। কচ্ছপ মন্দর পর্বতকে বহনে সম্মত হলেন।

বাসুকি-নাগকে দড়ি করা হল। লেজের দিক দেবতারা এবং সম্মুখভাগ অসুররা ধরল। তারপর শুরু হল সিন্ধু সমুদ্র মন্থন।

পাহাড়ের ঘর্ষণে বাসুকি নিশ্বাস ছাড়লেন। তা আকাশে মেঘের সৃষ্টি করল। দেবতারা সেই মেঘ থেকে বৃষ্টি সৃষ্টি করে সকলের ক্লেশ দুর করলেন।

সাপের গর্জনে ত্রিভুবন কাঁপতে লাগল। বিষের জ্বালায় অনেক দৈত্য মরল। মন্দরের আন্দোলনে বরুণ উথাল পাথাল হল। জলচরেরা প্রাণ ত্যাগ করতে শুরু করল। পর্বতের ঘর্ষণে পাহাড়ের গাছে আগুন লেগে গেল। এভাবে পর্বতবাসীরা মরতে লাগল।

এসব দেখে বিষ্ণু কষ্ট পেলেন। তার আজ্ঞায় মেঘ পর্বতে বৃষ্টি ঘটাল। আগুন নিভল। ঔসধিগাছের রস সমুদ্রে পড়ল। জলচররা সেই রসে পুনরায় প্রাণ পেল।

এত শ্রম করে সমুদ্র মন্থন করা হল কিন্তু অমৃত উঠল না। দেবতারা ব্রহ্মাকে বললেন তারা পুনরায় মন্থনের মত শক্তি পাচ্ছেন না।

ব্রহ্মা বিষ্ণুকে স্মরণ করলেন। বিষ্ণুর তেজে দেবতারা পুনরায় শক্তি পেলেন এবং মন্থন শুরু করলেন।

হঠাৎ দ্বিজরাজ চন্দ্র মন্থনের ফলে সমুদ্র থেকে উঠলেন। তাকে দেখে সুরাসুর-নর সকলে খুশি হল।
পুনরায় মন্থন শুরু হলে ঐরাবত নামে হাতির আবির্ভাব হল।
তারপর উঠল উচ্চৈঃশ্রবা নামে ঘোড়াটি।
পরে পারিজাত পুষ্পবৃক্ষ উঠল।
এরপর অমৃতের কমন্ডলু বাঁ কাঁধে নিয়ে ধন্বন্তরিকে উঠতে দেখলেন সুরাসুর সকলে।
বিভিন্ন রত্নও উঠতে লাগল।
আনন্দে দেবাসুর পুনরায় মন্থন শুরু করল।

মন্দর পর্বতের আন্দোলন বরুণ আর সহ্য করতে পারলেন না। পাত্র-মিত্র নিয়ে তিনি বিচারে বসলেন।

সকলে ঠিক করলেন বিষ্ণুর স্মরণ নেবেন।
মন্থনের ফলে কমলকাননে যে কন্যার জন্ম হবে তা দিয়ে বিষ্ণুর পুজা করা হবে ঠিক হল। পূর্বে কন্যার নাম ছিল লক্ষ্মী। মুনির শাপে তাকে পুনর্বার জন্মাতে হয়। এখন সে শাপমুক্ত। তার কারণেই সমুদ্র মন্থন হয়। নারায়ণ তাকে পেলেই এই মন্থন বন্ধ করে দেবেন।

এত কথা শুনে জলরাজ বরুণ আর দেরি করলেন না। চতুরদোলা বানিয়ে পুত্রের সঙ্গে নিজে তা কাঁধে নিয়ে চললেন। নারীরা চামর দোলাতে লাগল।

সহস্র ফণার ছত্র মাথায় নিয়ে মা লক্ষ্মী উঠে এলেন। তাঁর রূপে ত্রিভুবন মোহিত হল। সূর্য তার কাছে ম্লান মনে হল। লক্ষ্মী যেন পদ্মফুল দিয়ে গঠিত - অতি কোমলা। তাঁর দেহ বিদ্যুতের মত রত্ন দিয়ে সজ্জিত।
স্বর্গ–মর্ত-পাতাল সকলের অধিবাসীরা তাকে নত মস্তকে প্রণাম জানালেন। চতুরদোলায় করে তাঁকে নারায়ণের কাছে নিয়ে যাওয়া হল।

লক্ষ্মীকে নারায়ণের হাতে তুলে দিয়ে বরুণ সবিনয়ে জানতে চাইলেন তিনি কি পাপ করেছেন যে তার জল-রাজ্যে এত দুঃখ-দুর্দশা দেখা দিয়েছে। জলের একটিও প্রাণী বেঁচে নেই মন্দর পাহাড় এবং দেবাসুরের কর্মকান্ডের ফলে।

তার এই দুঃখের কথা শুনে বিষ্ণু বললেন দুর্বাশার শাপে লক্ষ্মীকে সিন্ধু সাগরে প্রবেশ করতে হয়। লক্ষ্মী বিহনে সারা জগৎ অচল। সেই কারণেই সমুদ্র মন্থন। এখন লক্ষ্মীই যখন উঠে এসেছেন তখন সমুদ্র মন্থনের আর কোন প্রয়োজন নেই।

একথা শুনে বরুণ হৃষ্টচিত্তে তার রাজ্যে গমন করলেন।

সমুদ্র মন্থনের ফলে যে কৌস্তভ রত্ন উঠেছিল-যার কিরণ চন্দ্র-সূর্য তুল্য, তা বিষ্ণুর গলায় শোভা পেল। লক্ষ্মীকে বিষ্ণুর হাতে দিয়ে বরুণ হৃষ্ট মনে ফিরলেন।

...............

নারদ কর্ত্তৃক মহাদেবের নিকট সমুদ্রমন্থনের সংবাদ প্রদান:

সুরাসুর, যক্ষ, রক্ষ, ভুজঙ্গ, কিন্নর সকলে মিলে সিন্ধু মন্থন করলেন। অথচ, শিব কিছুই জানতে পারলেন না দেখে নারদমুনি চিন্তিত হলেন।

কৈলাসে গিয়ে তিনি হর–পার্বতীকে সব জানালেন। বললেন, বিষ্ণু কমলা(লক্ষ্মী), কৌস্তভমণি প্রভৃতি পেয়েছেন। ইন্দ্র ঊচ্চৈঃশ্রবা, ঐরাবত পেলেন। নানা রত্ন পেলেন লোক, জলধর(সমুদ্র) পেলেন জল, দেবতারা অমৃত পেলেন, নরলোক পেল নানা ধাতু, মহৌষধি –এভাবে স্বর্গ, মর্ত, পাতালের সকলেই সব কিছু পেল, কেবল তাঁরা বাদে!

এভাবে তিনি মহাদেবকে উত্তেজিত করতে চাইলেন। শিব শান্ত মনে সকল কথা শুনলেন।

কিন্তু পার্বতী ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি মহাদেবকে শান্ত দেখে উত্তেজিত হয়ে নারদকে বললেন -এত কথা কাকে বলছে সে! বৃক্ষকে কথা শুনালেও সে শুনতে পায় না। কন্ঠের হাড়মালা যার ভূষণ কৌস্তভমণি তার কি প্রয়োজন! চন্দনে তার প্রয়োজন নেই ধূলিতেই তার কাজ। অমৃতের চেয়ে সিদ্ধিগুলিতেই তার আসক্তি, হাতির বদলে বলদবাহনই তার শ্রেয়, পারিজাতের তুলনায় ধুতরাই তার কাছে শ্রেয়। এসব চিন্তা করলেই পার্বতীর অঙ্গ জরজর করে। এই শিবের জন্যেই পূর্বজন্মে তাকে দেহত্যাগ করতে হয়।

পার্বতীর এত কথা শুনে শিব হেসে বললেন তাঁর এসবের প্রয়োজন নেই। সকলে যা ত্যাগ করে তিনি তাই গ্রহণ করেন।
ঘৃণা করে ব্যাঘ্রচর্ম কেউ নিল না, তাই তাকে ব্যাঘ্রচর্ম পরিধান করতে হল। অগুরু, চন্দন, কুঙ্কুম, কস্তুরী সকলে নিলেও বিভূতি কেউ না নিলে তিনি বিভূতি ভূষণ ধারণ করলেন।
মণিমুক্ত সকলে গ্রহণ করলে তিনি নিলেন হাড়মালা।
ধূতুরাফুল সকলে বর্জন করলে তিনি তা গ্রহণ করলেন।
রথ, গজ-প্রভৃতিকে সকলে বাহন করে বলদকে সরিয়ে দিলে, তিনি বলদকেই বাহন নির্বাচন করেন।
প্রথমে দক্ষ তাঁকে না জেনে পূজা করেনি তাই অজ্ঞান তিমিরে দক্ষ মোহিত হলেন। যদিও এর সমুচিত দন্ড তিনি পান। তার মাথা ছাগলের মুন্ডে পরিণত হয়। যজ্ঞকুন্ড মূত্রপূরীষে পূর্ণ হয়।

তিনি পার্বতীকে বললেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্র, যম, বরুণ, তপন সকলেই তাঁর পূজা করেন।

পার্বতীও বললেন সকলে যে তাঁকে কেমন পূজা করেন তা তিনি বুঝেছেন, তাইতো তাঁকে কিছু না দিয়ে নিজেরা সবকিছু ভাগ করে নিয়েছেন।

তিনি আরও বললেন, সংসারী পুরুষ বলদ, ধুতরা, হাড়মালা প্রভৃতি গ্রহণ করে না। তাদের স্ত্রী-পুত্র নিয়ে থাকতে হয়। সম্পত্তি, ঐশ্বর্য, বিদ্যা প্রভৃতি থেকে কোন সংসারী বিমুখ নয়।
যে সংসারী এ থেকে বিমূখ তাকে কাপুরুষ বলা উচিত।

এত কথা শুনে শিব ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি নন্দীকে বলদ সাজাতে বললেন।
..............................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers