Blog Archive

Sunday, May 31, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৯০

[পূর্বকথা - দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে অর্জুন অনায়াসে লক্ষ্যভেদে সক্ষম হলেন .......রাজা দ্রুপদ পুরোহিত পাঠিয়ে পঞ্চপাণ্ডবদের আমন্ত্রণ জানান....যুধিষ্ঠির বলেন মায়ের বচনানুসারে দ্রৌপদীকে পাঁচভাই বিবাহ করতে চান....যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে...দ্রুপদরাজ যখন তার কন্যার বিবাহ নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত, সে সময় অন্তর্যামী সর্বজ্ঞ মুনিরা পান্ডবদের বিবাহের উদ্দেশ্যে সেখানে উপস্থিত হলেন, তারা দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামী হওয়ার কারণ জানালেন........]

কেতকীর প্রতি সুরভীর শাপঃ



সুরভী(স্বর্গের কামধেনু)

কেতকীর অপূর্ব কাহিনী শুনে দ্রুপদ জিজ্ঞেস করেন –হে তপোধন আরো বলুন –কার কন্যা ছিলেন কেতকী, কেনই বা তিনি তাপসী হলেন। কি হেতুই বা তিনি গঙ্গাতীরে বসে কাঁদছিলেন। সে কাহিনী ও আমায় জানান মহাঋষি।

অগস্ত্য বলেন –শুনুন তার কাহিনী-সত্যযুগে সে দক্ষের কন্যা ছিলেন। বিবাহ না করে সন্ন্যাস ধর্ম নিয়ে হিমালয়ের মন্দিরে শিবের পূজায় নিজেকে নিবেদন করল।

হরের কাছে সে প্রার্থনা করল –তোমার বাসস্থানে আমি তপস্যা করতে চাই। তুমি আজ্ঞা দিলে আমি নির্ভয়ে থাকব।


হর(শিব) বললেন -থাক এই গিরিবরে। আমার কাছে থাক, কোন ভয় নেই। কোন পুরুষ যদি তোমায় কামনা করে তবে দ্রুত তাকে আমার কাছে আনবে।

হরের আশ্বাস পেয়ে কেতকী সেখানে একাসনে তপস্যায় নিযুক্ত হলেন।

দৈবক্রমে একদিন সেখানে সুরভী(স্বর্গের কামধেনু) উপস্থিত হলেন। ঋতুমতী গাভী দেখে পাঁচটি ষন্ড তাকে অনুসরণ করল। সুরভীকে পাওয়ার জন্য ষন্ডে ষন্ডে যুদ্ধ শুরু হল।
ষন্ডের গর্জনে কেতকী ধ্যানভঙ্গ হল। পাঁচটি শক্তিশালী ষন্ডের সাথে সুরভীকে দেখে কেতকী ঈষৎ হাসলেন।

কেতকীর হাসি দেখে সুরভী বুঝলেন উপহাস করা হচ্ছে তাকে, মনে মনে তিনি কষ্ট পেলেন এবং বেগে গিয়ে গোমাতা-সুরভী কেতকীকে শাপ দিলেন –আমি গরু জাতির তাই এতে আমার কোন লজ্জা নেই। নরযোনি হয়ে তোরও পঞ্চস্বামী হবে। বারবার তুই মানবী হয়ে জন্মাবি। দুই জন্ম তোর বৃথা যাবে, হে বিরহিনী! তৃতীয় জন্মে তোর পাঁচ স্বামী হবে। সে জন্মে লক্ষ্মীর অঙ্গে জন্মে মুক্তি পাবি। তোর পঞ্চস্বামী একজন অংশে জন্মাবে, তাদের মধ্যে ভেদাভেদ থাকবে না, সবার মনের মিল থাকবে।

কেতকী যোড়হাতে বলেন –অল্প দোষে এত বড় শাপ দিলেন! কতকালে এই শাপ মোচন হবে। এক অংশে কারা পাঁচজন হবেন। আপনি যখন শাপ দিলেন তখন আমিও অবশ্যই তা ভোগ করবো কিন্তু আমার সব প্রশ্নের উত্তরগুলি দিন।

সুরভী বলেন -তবে শোন। একা ইন্দ্র অংশেতে হবেন পাঁচজন।
বৃত্রাসুর নামে ত্বষ্টামুনির পুত্র ত্রিভুবন জয় করলে ইন্দ্র তাকে বজ্র মেরে হত্যা করেন।
শুনে ত্বষ্টামুনি ক্রোধে আগুন হয়ে বলেন –আজ আমি ইন্দ্রকে মারব। আমার তপস্যাব্রত বৃথা হওয়ার নয়। ইন্দ্রের মত ব্রহ্মবধী বিশ্বাসঘাতক দুরাচারের পাপের ভার ধর্মদেব কি ভাবে বহন করছেন! ত্রিশিরস পুত্র আমার তপস্যা করছিল। অনাহারী, মৌনব্রতী সে কাউকে হিংসাও করত না। এমন পুত্রকেও সেই দুষ্টাচার মেরেছিল। আজ আমি দৃষ্টির দ্বারা তাকে ভস্ম করবই।

এই বলে মুনি দাঁত কড়মড় করতে করতে ধেয়ে চললেন। দেখে সুরাসুর সকলে ভয়ে পালাতে থাকে।

বায়ু দ্রুত ইন্দ্রের কাছে গিয়ে বলেন –ইন্দ্র আপনি নিশ্চিন্তে বসে আছেন! ক্রোধান্বিত ত্বষ্টামুনি আপনাকে হত্যা করতে আসছেন। হাতে হাত কচলে, উরুতে চড় মারতে মারতে তিনি এগিয়ে আসছেন। তার চরণভারে পৃথিবীও কাঁপছে। লম্বা ঘন দাড়ি নাড়তে নাড়তে, মেঘের গর্জনের মত নিশ্বাসের ঝড় তুলতে তুলতে, নেত্রানলে বন পুড়িয়ে, পায়ের চাপে বৃক্ষ ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে তিনি এগিয়ে আসছেন। আমার মতে আপনি এখন আর বাহনে না চড়ে এগিয়ে তার হাতেপায়ে ধরে পরুন। নয়ত এখনই পালান।

শুনে ইন্দ্র ভয় পেলেন। মুখে কথা ফুটল না, জড়ের মত দাঁড়িয়ে রইলেন। কোথায় লুকাবেন ভেবে পেলেন না। আদেশ দিলেন যত হাতি ঘোড়া আছে সব নিয়ে আসার জন্য। ঐরাবত প্রমুখ বড় বড় হাতিরা তাকে চতুর্দিকে ঘিরে রাখল।

দূর থেকে ক্রোধে ত্বষ্টামুনিকে দেখে ইন্দ্র প্রচন্ড ভয় পেলেন। কোথায় পালাবেন ভেবে পেলেন না।
কাছেই চারজন দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের নিজের চারঅংশ সমর্পণ করে পঞ্চ আত্মা নিজের মধ্যে ধারণ করে রাখলেন। সেই চারজন হলেন–ধর্ম, বায়ু ও অশ্বিনীকুমার দুই ভাই।
সে সময় সেখানে ত্বষ্টা মহাঋষি এসে দৃষ্টিমাত্রে পুরন্দর-ইন্দ্রকে ভস্ম করলেন।
ইন্দ্রকে ভস্ম করে তিনি ইন্দ্রের আসনে বসে দেবতাদের বললেন –আজ থেকে আমিই ইন্দ্র।

সুরভী কেতকীকে বলেন –এভাবে ইন্দ্র পাঁচভাগে বিভক্ত হলেন। সেই পাঁচ অংশ থেকেই তোমার পাঁচ স্বামীর জন্ম হবে এবং তাদের স্ত্রী তুমি হবে।
কেতকী বলেন –হে গো জননী, কি ভাবে বজ্রপাণি ইন্দ্র পুনরায় প্রাণ পেলেন, সে কথা জানান।



সুরভী বলেন –ত্বষ্টামুনি ইন্দ্রের সিংহাসন জয় করলে দেবতারা ব্রহ্মার কাছে গিয়ে বলেন–ইন্দ্র ছাড়া আমরা স্বর্গপুরে থাকতে পারছি না। ইন্দ্রের সেই সুন্দর সভা ভেঙ্গে গেছে। অপ্সরা অপ্সরীরা আর নৃত্য-গীত করে না। সব সময় অসুরদের উপদ্রপ চলছে। তাই আমরা থাকতে না পেরে আপনার কাছে চলে এলাম।
সব শুনে ব্রহ্মা নারদকে ত্বষ্টামুনির কাছে দূত করে পাঠালেন।

নারদ গিয়ে ত্বষ্টামুনিকে বলেন –ইন্দ্রত্ব নিয়ে তুমি ইন্দ্রের কাজ করতে চাইলে। কিন্তু ইন্দ্র বিনা রাজ্যে উপদ্রপ বেরে চলেছে।

মুনি বলেন –ইন্দ্রত্বে আমার প্রয়োজন নেই। জপ-তপ-ব্রতই আমার প্রকৃত কর্ম। যার ইচ্ছে এই ইন্দ্রত্ব আমার কাছ থেকে এখন নিয়ে যেতে পারে।

ত্বষ্টার কথা শুনে নারদ বলেন –ইন্দ্রকে সৃষ্টির কারণেই বিধাতা তৈরী করেছিলেন। বিনা ইন্দ্রে ইন্দ্রত্ব কে নেবেন। আপনি যদি ইন্দ্রত্ব না নিতে চান তবে ক্রোধ ত্যাগ করে বজ্রপাণি(ইন্দ্র)কে প্রাণ দান করুন। আমার অনুরোধে বিধাতার সৃষ্টিকে রক্ষা করুন।

শুনে ত্বষ্টামুনি সব বুঝতে পারলেন। ইন্দ্রের ভস্ম তার সামনে আনা হল। শান্ত দৃষ্টিতে ভস্মে দৃষ্টিপাত করে ইন্দ্রকে জীবন্ত করলেন। এইভাবে ইন্দ্র পুনরায় প্রাণ পেলেন।

তোমাকে পুরাণের অনেক কথা বললাম। এই বলে সুরভী নিজের স্থানে চলে গেলেন।

অনেক চিন্তা করে কেতকী ধ্যান করতে বসলেন। একদিন গঙ্গাতীরে বসে মনের দুঃখে যখন কাঁদছিলেন তখন তার অশ্রুবিন্দু সোনার পদ্ম হয়ে ভেসে যাচ্ছিল।

অগস্ত্যমুনি এসব গল্প বলতে বলতে স্বর্গের দুন্দুভি বেজে উঠল।
দেবতারা এসে বলেন –পঞ্চপান্ডবের জন্যেই কৃষ্ণার জন্ম। শীঘ্র শুভকর্ম সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করুন। আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি শুরু হল। ইন্দ্র পাঠালেন দিব্য আভরণ(অলঙ্কার)-কেয়ুর(বাহুর), কুন্ডল(কানের), হার, কঙ্কণ, অম্লান অম্বর(বস্ত্র), পারিজাত(সমুদ্রজাত) পুষ্পরাজ(পদ্মরাগমণি)। বিচিত্ররথ সহ সুন্দরী রমণীদল।

সেই সময় বলরাম ও নারায়ণ কৃষ্ণ উপস্থিত হলেন। তাদের সাথে দ্বারকার সকল স্ত্রী ও পুরুষরাও এল।

বিবাহের মঙ্গলদ্রব্য নিয়ে কৃষ্ণের পিতা বসুদেব এলেন। স্ত্রীলোকেরা গরুড়ের পিঠে চড়ে এলেন। কৃষ্ণের মা-দেবকী, বলরামের মা-রোহিনী, বলরামের স্ত্রী রেবতরাজকন্যা রেবতী, কৃষ্ণের স্ত্রীরা-রুক্মিণী, কালিন্দী, সত্যভামা, জাম্বুবতী, লগ্নজিতা, মিত্রবৃন্দা, ভদ্রা, সুলক্ষণা ও আরো সব যদুনারী। তারা সকলে নানা রত্ন-ভূষণ-অলঙ্কার উপহার আনলেন। দশকোটি অশ্ব, দশকোটি রথ, দশকোটি মাতঙ্গ(হাতি), অগণিত বৃষভ(ষাঁড়), উট, খর(গাধা)টানা গাড়ি এলো-যেগুলি ধনে পূর্ণ। এসবই কৃষ্ণ ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে উপহার দিলেন। মনে মনে যুধিষ্ঠির অপার আনন্দ লাভ করলেন। পঞ্চপান্ডব মাতুলালয়ের সকল যদুদের প্রণাম জানালেন।
দ্রুপদরাজও সকলকে পূজা করে আদর আপ্যায়ন করলেন।

মহাভারতের কথা অপ্রমিত সুধা, সতত শুনহ নর ভারতের কথা।
...................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers