Blog Archive

Tuesday, March 24, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৮৫

[পূর্বকথা - দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে অর্জুন অনায়াসে লক্ষ্যভেদে সক্ষম হলেন ...অন্যান্য রাজা ক্রুদ্ধ হল... অর্জুনের সাথে তাদের যুদ্ধ শুরু হল .... ব্রাহ্মণদের সাথেও ক্ষত্রিয়দের যুদ্ধ শুরু হল...কর্ণও হার মানলো...যুদ্ধে বিমুখ হয়ে রাজারা পলায়ন করল...ভীমের যুদ্ধে রাজপরিবাররা আতঙ্কিত হল...] 

 

অর্জ্জুনের সহিত দ্রৌপদীর কুম্ভকারালয়ে গমনঃ 

মুনি বলেন –মহারাজ জন্মেজয় এরপর কি হল শুনুন। 
যুদ্ধে জয়লাভ করলেন ভীম ও ধনঞ্জয়। সমস্ত দিবস গেল সন্ধ্যাকাল এল। ধীরে ধীরে তারা বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। তাদের পিছন পিছন দ্রুপদনন্দিনী চললেন। তাদের ঘিরে রইল সকল দ্বিজ-ব্রাহ্মণের দল। 
ভীম ও অর্জুন মনে মনে চিন্তা করতে থাকেন কিভাবে এই ব্রাহ্মণের দলের থেকে বের হবেন। 

যোড়হাতে কৃতাঞ্জলি করে তারা বলেন –আজকের মত সবাইকে বিদায়। 

তাদের কথা শুনে ব্রাহ্মণরা বলে –এমন অপ্রিয় কথা বলবেন না। তোমাদের সঙ্গ আমরা ছাড়ছি না কখনও। নাজানি ক্ষত্রিয়েরা এরপর তোমাদের উপর কখন আক্রমণ করে। রাত্রে তোমাদের একা পেয়ে হত্যা করে দ্রৌপদীকে কেড়ে নিতে পারে। যতদিন এ দেশে ক্ষত্রিয়রা থাকছে ততদিন আমরা সবাই চারদিক থেকে তোমাদের ঘিরে রক্ষা করব। 

পার্থ হেসে বলেন –সে ভয় আর করবেন না। আজ আপনারা বিশ্রাম নিন। কাল আবার মিলিত হব। 
অনেক ভাবে বুঝিয়েও দ্বিজদের সঙ্গ ছাড়ান গেলনা। সেই ব্রাহ্মণদলের মধ্যে ধৌম্য ছিলেন। তিনি বুদ্ধি করে সকল ব্রাহ্মণদের নিভৃতে ভেবে বলেন –এই অচেনা দুজনের সাথে কোথায় চলেছ, কেউ কি এদের চেনো! এরা কোন জাতির, এরা কি দৈত্য নাকি দেবতা, হয়তবা রাক্ষস-কিন্নর। কার পুত্র এরা, কোন দেশে এদের ঘর কেউ জানি না। তবে এদের সাথে থাকার কি প্রয়োজন! এদের যেখানে ইচ্ছা যাক। 
ধৌম্যের কথা শুনে সবার মনে ভয় হল। তারা পিছু নেওয়া ছাড়ল। 

সেই দ্বিজদলের মধ্যে ধৃষ্টদ্যুম্নও ছদ্মবেশে ছিল। সে বোনের প্রতি মমতা ছারতে না পেরে বোনকে অনুসরণ করছিল। ব্রাহ্মণরা চলে গেলেও সে অন্ধকারে ভীমার্জুনের পিছু নিল। 

যুধিষ্ঠিরও নকুল সহদেবকে নিয়ে অন্যপথে সেই গৃহে ভাইদের সাথে মিলিত হলেন। 

এদিকে কুম্ভকারের গৃহে ভোজকন্যা কুন্তীদেবী সারাদিন পুত্রদের অপেক্ষায় বসে রইলেন। রাত উপস্থিত কিন্তু পুত্রদের দেখা নেই। তাঁর হৃদয় ব্যাকুল হল, তিনি কাঁদতে লাগলেন। কি কারণে পুত্ররা এখনও ফিরল না। ভীম নিশ্চয়ই কারো সাথে ঝগড়া করেছে। চারদিকে সৈন্যের কোলাহল শোনা যাচ্ছে। সকলে ‘দ্বিজ মার’ রব তুলেছে। ভীমতো যুদ্ধ ছাড়া কিছুই বোঝে না। আজও নিশ্চয়ই কারো সাথে তাঁর বিবাদ হয়েছে। সেই কারণেই হয়ত ক্ষত্রিয়রা দ্বিজ মারতে বেরিয়েছে। এসব ভেবে কুন্তীদেবী বহু বিলাপ করতে থাকেন। 

 
সেই সময় পঞ্চপান্ডবরা গৃহে উপস্থিত হলেন। 
বৃকোদর ভীম হৃষ্টচিত্তে মাকে ডেকে বলেন –আজ মা, সমস্তদিন দুঃখ পেলে। উপবাসে মহাক্লেশে দিন কাটালে। আজ অনেক কলহ হয়েছে, সেজন্য ফিরতে আমাদের রাত হয়ে গেল। রাতে কি ভিক্ষা মিলল এসে দেখ, মা! 

কুন্তীদেবী ঘরের ভিতর থেকে বলেন –যা এনেছ তা পাঁচভাই ভাগ করে নাও। তোমাদের কন্ঠস্বর শুনেই আমি সুখি। আজ এই আনন্দে আমার ক্ষুধা ডুবে গেছে। আমার সোনারচাঁদ বাছাধনরা আমার কাছে এস। তোমাদের ছুঁয়ে দেখি। 
এই বলতে বলতে কুন্তীদেবী ঘর থেকে বার হলেন। একে একে সবার শিরে চুম্বন করলেন। 
সবার পিছনে তিনি দ্রুপদনন্দিনীকে দেখতে পেলেন। পূর্ণ শশধরমুখী(চাঁদের মত মুখ), গজেন্দ্রগামিনী দ্রৌপদীকে দেখে অবাক হয়ে কুন্তী পাঁচপুত্রকে জিজ্ঞেস করেন –কে এই সুন্দরী সবার পিছনে দাঁড়িয়ে। 

ভীম বলেন –মা, এ দ্রুপদকন্যা। একচক্রানগরে যার কথা শুনেছিলে। এর জন্যই বহু বিরোধ হল। তোমার আশির্বাদে যদিও জয়লাভ করেছি। এই ভিক্ষার জন্যই এত রাত হল, মা! যদিও অন্য ভিক্ষা করলে খাদ্যান্ন মিলত। 

কুন্তী অনুতাপ করে বলেন –আগে যা বলেছি, কিছু না জেনেই বলে ফেলেছি। কেন এমন বললে পুত্র, কি কাজ করলে! কন্যা এনে কেন ভিক্ষা যে বললে! ভিক্ষে ভেবে বললাম পাঁচজনে ভাগ করে খাও। এখন কি ভাবে আমার সে বাক্য তোমরা লঙ্ঘ করবে! মায়ের বচন বেদের সমান। 
এত বলে কুন্তীদেবী বিলাপ করতে লাগলেন। 

শেষে তিনি দ্রৌপদীর হাত ধরে যুধিষ্ঠিরের সামনে কাঁদতে কাঁদতে বলেন –তুমি সর্বধর্ম জ্ঞানী। তুমি এর বিচার কর। আমি যা বলেছি তুমি শুনেছ। পুত্র হয়ে আমার বাক্য কি ভাবে লঙ্ঘন করবে! কিন্তু তা লঙ্ঘন না করলে কথাটার বিপরীত অর্থ হবে। আমার আজ্ঞা লঙ্ঘন যেমন সম্ভব নয় তেমনি দ্রুপদকন্যার সাথেও যেন কোন ধর্মচ্যুতি না ঘটে দেখ। সব বিচার বিবেচনা করে তুমি বিধান দাও। 
এই বলে মাতা কুন্তী কাঁদতে থাকেন। 

মায়ের কথা শুনে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের ব্যাসের বলা কথাগুলি মনে পরল। একচক্রানগরে ব্যাস মুনি বলেছিলেন –পূর্বে এক দ্বিজ কন্যাকে শূলপাণি(শিব) বলেছিলেন তাঁর পঞ্চস্বামী হবে। সেই কন্যাই কৃষ্ণা নামে এখন জন্মেছেন। 
সব ভেবে যুধিষ্ঠির মাকে আশ্বাস দেন –তোমার বচন লঙ্ঘন হবে না, মা। 

অর্জুনের মন বোঝার জন্য ধর্মপুত্র তাঁর কাছে গিয়ে বলেন –অনেক বড় কাজ করে, বহুকষ্টে লক্ষ্যভেদ করে, রাজাদের হারিয়ে এই দ্রুপদকন্যা তুমি লাভ করেছ। শুভ কার্যে দেরি করা উচিত নয়। ধৌম্য ও অন্যান্য ব্রাহ্মণদের ডেকে এখনই এই শুভক্ষণে তুমি দ্রৌপদীকে বিবাহ কর। 

কৃতাঞ্জলি হয়ে ধনঞ্জয় কহেন –সব জেনে আপনি এমন কথা কি ভাবে বলছেন। বেদ লঙ্ঘন সম্ভব নয়। দুরাচার বলে লোকে নিন্দা করবে। আমার আগে বিবাহ আপনার হবে। প্রথমে আপনার, তারপর ভীমের, তারপর আমার বিবাহ সম্ভব শাস্ত্রমতে। 

পার্থের বাক্য শুনে ধর্মপুত্র হৃষ্টচিত্তে ভাইকে আলিঙ্গন করে শিরে চুম্বন করেন। 

তারা যখন গৃহে প্রবেশ করছেন সে সময় বলরাম ও হৃষীকেশ(কৃষ্ণ) সেখানে উপস্থিত হলেন। 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান, শুনলে অধর্ম খন্ডে ও বৈকুন্ঠে(বিষ্ণুলোকে) প্রয়াণ হয়। 
................................. 

 

কুন্তীর নিকট শ্রীকৃষ্ণের আগমনঃ 

বলরাম ও কৃষ্ণ কুন্তীকে প্রণাম করে নিজেদের পরিচয় জানান। পরিচয় জানতে পেরে শূরসেন-কন্যা কুন্তীদেবী দুজনকে কাছে টেনে আদর করতে করতে কেঁদে ফেলেন। 
কুন্তী বলেন – কোথায় ছিলি তোরা, আমার চোখের মণি, অন্ধের নড়ি! বার বছর হয়ে গেল তোদের মুখ দেখতে না পেয়ে কেঁদে দুর্বল হয়েছি। আজকের রাত্রি আমার জন্য সুপ্রভাত নিয়ে এলো। বার বছরের কষ্ট আজ মিটল। হে প্রিয় পুত্ররা সবার কুশল সমাচার দাও। আমার প্রিয় ভাই বাসুদেব ও তোমাদের মা কেমন আছেন! বার বছর কোন খবর জানি না। কে বেঁচে আছে কেইবা মারা গেছে-কোন খবর পাই না। তোমাদের পিতাও কম নির্দয় নন। বার বছর আমি এই অরণ্যে ঘুরে মরছি, কিন্তু কেউ আমার খবর নেওয়ার চেষ্টা করেনি। 

কৃষ্ণ বলেন –দেবী! মনস্তাপ ত্যাগ করুন। গৃহদাহে আপনারা মারা গেছেন শুনে পিতা দুঃখে সাতদিন অন্নজল স্পর্ষ করেন নি। আমাকে পাঠিয়েছিলেন কি ঘটেছে জানতে। বিদুরের সাথে দেখা করে সব বুঝতে পেরে কিছুটা স্বস্তি পাই। বার বছর আপনারা অরণ্যে কষ্ট পাচ্ছেন, পিতাও আপনার কথা ভেবে অশ্রুজলে ভাসছেন। কিন্তু বিধির লিখন খন্ডন সম্ভব নয়। আর শোক করবেন না, দুঃখের শেষ হয়েছে। কাল বা পরশু নিজের দেশে ফিরে চলুন। 

 
কুন্তীকে প্রণাম জানিয়ে তারা ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের কাছে এলেন। যোড়হাতে প্রণাম জানাতেই যুধিষ্ঠির দ্রুত উঠে এসে তাদের আলিঙ্গন করেন। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে তারা অশ্রুজলে ভাসতে থাকেন। কেউ কাউকে ছারতে চান না। বহুক্ষণ তাদের মুখে কথা ফোটে না। 
শেষে রাম ও কৃষ্ণ বসে পাঁচ ভাইয়ের পূর্বের কষ্টের সকল কথা শোনেন। যুধিষ্ঠির বলতে থাকেন জতুগৃহ কিভাবে পুড়ল, বিদুরের মন্ত্রণায় কেমন ভাবে তারা উদ্ধার পেলেন, রাক্ষসের হাত থেকে কিভাবে রক্ষা পেয়ে বনে বনে দেশে দেশে তপস্বীর বেশে বার বছর কষ্ট করলেন। একে একে সব ঘটনার বিবরণ দিলেন। 

সব শুনে দেবকীনন্দন আশ্বাস দিয়ে বলেন –দুষ্ট ধৃতরাষ্ট্র ও তার নষ্ট পুত্ররা যে অন্যায় করছে তার ফল অবশ্যই তারা পাবে। যদি ভাল ভাবে তারা রাজ্যপাট ভাগ করে না দেয় তবে সকলে মিলে তাদের সংহার করব। 

যুধিষ্ঠির বলেন – হে, দামোদর[কৃষ্ণ=দাম-দড়ি+উদর-কোমরঃশৈশবে দূরন্তপনার জন্য মা যশোদার হাতে কোমরে দড়ি দিয়ে রাখা হত]! কিভাবে জানলেন আমরা এই কুম্ভকারের ঘরে আছি! 

শ্রীকৃষ্ণ বলেন –যা কান্ড ভীমার্জ্জুন করল পৃথিবীতে আর কারো পক্ষে এমন করা অসম্ভব। তাতেই তোমাদের চিনতে পেরেছি এবং এখানে আশ্রয় নিয়েছ বুঝতে পেরেছি। অগ্নি যেমন গুপ্ত থাকলেও প্রকাশ পায়, তেমনি তোমাদের বিক্রম তোমাদের চিনিয়েছে। 

যুধিষ্ঠির বলেন –আজ আমাদের সৌভাগ্য যে স্বচক্ষে জগন্নাথ দর্শন করলাম। কেবল একটি ভয় হচ্ছে সবাই যানতে পারে আমরা এই কুম্ভকারের ঘরে আছি। বিশেষ করে তোমার আগমন গোপন থাকবে না। এই বার্তা তো দূর্যোধনও পেয়ে যাবে। 

গোবিন্দ বলেন –রাজা কাকে ভয় করছ! শত দুর্যোধনই বা তোমার কি ক্ষতি করতে পারে! স্বর্গ-মর্ত-পাতালের সাহায্য নিয়েও যদি সে আসে তবু মুহুর্তে চক্ষের নিমেষে তাকে নিবারণ করব আমরা। সপ্তবংশ সহ আমি যজ্ঞসেনের সখা আর সবাইকে জয় করতে পারে ভীমার্জ্জুন একা। 

যুধিষ্ঠির বলেন –তাকে ভয় নয় কিন্তু জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্রকে বড়ই ভয় পাই। আজ এখানেই বাস করব। কাল কি করব সকালে ঠিক করতে হবে। 
এতসব বলে তারা পরস্পরকে আলিঙ্গন করেন। তারপর রাম ও নারায়ণ বিদায় নেন। 
মহাভারতের কথা অমৃত সমান। কাশীরাম কহেন সদা শুনে পূণ্যবান। 
................................... 

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৮৪

[পূর্বকথা দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে অর্জুন অনায়াসে লক্ষ্যভেদে সক্ষম হলেন ...অন্যান্য রাজা ক্রুদ্ধ হল... অর্জুনের সাথে তাদের যুদ্ধ শুরু হল .... ব্রাহ্মণদের সাথেও ক্ষত্রিয়দের যুদ্ধ শুরু হল...কর্ণও হার মানলো...যুদ্ধে বিমুখ হয়ে রাজারা পলায়ন করল...

রাজাদিগের যুদ্ধভঙ্গের বিবরণঃ 

 

সব ঘটনা শুনে রাজা জন্মেজয় আশ্চর্য হলেন। 
বিনয়ের সাথে তিনি মুনিবরকে জিজ্ঞেস করলেন –এই অদ্ভূত কথা আরেকটু শোনান। পৃথিবীর সব রাজারা সেখানে মিলেছিলেন। অসংখ্য অর্বুদ সৈন্য যা গণনাতীত-সবাইকে সেই দুইভাই পরাজিত করলেন। দ্রুপদরাজা ক্ষত্রিয় হয়েও ভয়ে সভা মাঝে কন্যা ফেলে পালালেন। কোথায় গেলেন ধর্মপুত্র মাদ্রীপুত্রদের নিয়ে! কোথায়ই বা গেলেন যদুবংশী শ্রীরাম(বলরাম)-অচ্যুত(স্বীয় পদ হতে যিনি চ্যুত হন না- বিষ্ণু/কৃষ্ণ)। সারা পাঞ্চালনগরে ভাঙচুর যখন হল, তখন কুম্ভকার ঘরে কুন্তীর কি হল! প্রাণভয়ে প্রজারা দেশান্তরে গেল। অন্তপুরে কি হল জানান। হৃদয়ে আমার এই অপূর্ব কথন শোনার উল্লাস জেগেছে। 

মুনি বলেন –রহস্য শুনুন, কুরুরাজ! যখন ক্ষত্রিয় সমাজ ঘিরে ধরেছিল তখন দ্রুপদরাজাও অনেক যুদ্ধ করেন ধৃষ্টদ্যুম্ন, সত্যজিৎ ও শিখন্ডীকে সঙ্গে নিয়ে। শিশুপালের সাথে সত্যজিতের যুদ্ধ হল। বিরাট ও শিখন্ডীর যুদ্ধ লোকে দেখল। তিন অক্ষৌহিনী সৈন্যদল নিয়ে তারা মহাযুদ্ধ করল। অনেক সংগ্রাম করে সৈন্যদের প্রাণ গেল। জরাসন্ধের সাথে দ্রুপদে যুদ্ধ হল। ধৃষ্টদ্যুম্ন করল কীচকের সাথে যুদ্ধ। 
সব দেখে শুনে দ্রণাচার্য দুর্যোধনকে ডেকে বলেন –যুদ্ধ থামাও ব্রাহ্মণদের সাথে যুদ্ধে কাজ নেই।ব্রাহ্মণের তেজ সর্বজন বিদিত। তাদের সাথে যুদ্ধ উচিত নয়। অবিহিত কর্ম করলে ধর্ম সহ্য করবেন না। অধর্মে প্রবৃত্ত হলে জয় কখনও হবে না। অনাথ দুর্বলের সাথে কৃষ্ণ বলবান সর্বক্ষণ আছেন জানবে। তাঁর সামনে দুষ্ট কর্ম করা ভাল নয়। গরুড় আরূঢ় হয়ে আছেন শ্রীপতি, তাঁর বলেই বীরজন যুদ্ধে লড়েন। হৃষীকেষ(হৃষীক-ইন্দ্রিয়+ঈশ-দেবতা=কৃষ্ণ) ক্রুদ্ধ হওয়ার আগে চল ভালোয় ভালোয় প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরে যাই। 

ভীষ্ম বলেন –ইনি কুন্তীপুত্র পার্থ নিশ্চিত ভাবে বুঝতে পারছি। অচল পর্বতের মত দাড়িয়ে আছেন। কারো শক্তি নেই একে পরাজিত করার। সাধারণ মানুষের পক্ষেও এমন লক্ষ্যভেদ অসম্ভব। কেইবা একা এত বিপক্ষকে নিবারণ করতে পারেন। শরতের মেঘ যেমন পবনকে উড়ায় তেমনি ভাবে সে বড় বড় রাজা রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য করেছে। 
ভীষ্ম আরো বলেন –দ্রোণ এখান থেকে যাবই বা কি ভাবে। লক্ষ রাজা এক ব্রাহ্মণকে ঘিরে ধরেছে। পরের জন্য, ব্রাহ্মণদের জন্য সাধুজনের জীবন ত্যাগ করতে হয়–নীতিশাস্ত্রে এমন কথা বলে সর্বক্ষণ। আমার সামনে এমন অন্যায় দেখে যাই কি করে! এই ব্রাহ্মণকে রক্ষার জন্য আজ রাজাদের মারব। আমি আচার্য তোমাকে একাজে চাই না। প্রাণপণে লোকে নিজে থেকেই স্বজাতির সাহায্য করে। দেখ হীনবস্ত্র দুর্বল ব্রাহ্মণরা জাতির কারণে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। ইনি যদি ব্রাহ্মণ না হয়ে কুন্তীপুত্র হন। তাকেইবা এই সঙ্কটে কিভাবে ফেলে যাই! 

দ্রোণ বলেন –একা পার্থ এদের জন্য যথেষ্ঠ। আজই পার্থের প্রকৃত বিক্রম বোঝা যাবে। এই যে অর্জুন যুদ্ধে পরিশ্রম করছেন-দেখ তাঁর বন্ধুরা ইনিই দুষ্টজনের যম। মুহুর্তে ইনি সবার সংহার করবেন। এখানে আর থাকার প্রয়োজন নেই। ওই দেখ বেগের সাথে হাতে তরুবর নিয়ে যিনি তেড়ে আসছেন তিনি আর কেউ নন বীর বৃকোদর ভীম। আমি তাঁর চরিত্র ভাল ভাবেই জানি। যুদ্ধে পরাপর জ্ঞান তাঁর থাকে না। আগের সেই ছোট্ট ভীমা বলে তাকে আর ভেব না। পিতামহ বলে তোমাকেও রেহাই দেবে না। জতুগৃহে পোড়ানোর ক্রোধ এখনও আছে। দেখ এই দিকেই গাছ হাতে এগিয়ে আসছে। চল এখান থেকে শীঘ্র সরে যাই নইলে মৃত্যু সামনে। 

বৃক্ষের বারি খেতে হবে বুঝে ভীষ্ম দ্রোণের কথা মত সে স্থান ত্যাগ করলেন। দুর্যোধনও তার সৈন্য নিয়ে তাদের সাথে চলে গেল। 

মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীদাস কহেন সাধু শুনে পুণ্যবান। 
.......................................... 

 

ভীমের যুদ্ধে রাজপরিবারদিগের ত্রাসঃ 


ভীমের ভৈরব নাদ, ভয়ঙ্কর মূর্তি, হাতে বৃক্ষ দেখে মনে হয় যেন যুগান্ত সামনে উপস্থিত। রাজারা চারদিকে দৌড়ায়, নগরে মহারোল ওঠে। 

সে সময় অন্তপুরের একজন দ্রৌপদীর কাছে এসে কেঁদে বলে –দেখ ছত্রভঙ্গ সৈন্যের দল সিন্ধু উথলানোর মত নগরে ঘুরছে, অত্যাচার করছে, ঘর-দ্বার ভাঙ্গছে। প্রাণ ভয়ে প্রজারা দেশান্তরে যাচ্ছে। অন্তঃপুরের অবস্থাওও যানা যাচ্ছে না। তোমার কারণে রাজা ধনে প্রাণে দেশ রাজ্য নিয়ে বিপদে নিমজ্জিত হচ্ছেন। 

শুনে দ্রুপদ নন্দিনী কাতরা হয়ে বলেন –কেশিনী, দ্রুত জনক দ্রুপদের কাছে গিয়ে বল যুদ্ধ ত্যাগ করতে। নিজের প্রাণ রক্ষা করে আত্মীয়-কুটুম্বদের রক্ষা করার জন্য অনুরোধ কর। বল আমি অনুরোধ করেছি স্ত্রী-সন্তানকে রক্ষা করুন। নিজের প্রাণরক্ষা করে স্ত্রীধন বাঁচান। নিজে প্রাণে বাঁচলে সকলি ধিরে ধিরে ফিরে পাবেন। আমার কারণে সবংশ ধ্বংস হবেন না। যে পণ পিতা করেছিলেন তাতো পূর্ণ হয়েছে। ব্রাহ্মণ লক্ষ্যভেদ করেছেন, সকলে তা দেখেছেন। আমি এখন এই ব্রাহ্মণের হয়েছি, ভালমন্দ যা হবে তা আমি বুঝে নেব। যাও শীঘ্র গিয়ে আমার বার্তা পিতাকে যানাও। 

কন্যার বার্তা পেয়ে দ্রুপদ ব্যথিত হলেন। 
পুত্রদের করুণ ভাবে বলেন –যাজ্ঞসেনী বলে পাঠিয়েছে যুদ্ধ বন্ধ কর। এ সৈন্য-সাগর নিবারণ আমাদের পক্ষেও সম্ভব নয়। সমানে সমানে সংগ্রাম সুশোভন। কিন্তু পতঙ্গের মত অগ্নিতে ঝাঁপ দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বিশেষত অন্তপুরে স্ত্রীদের কি হল জানি না। নিজেদের প্রাণরক্ষা করে অন্তপুরবাসিদের সাহায্য কর। আমি এখানে দ্বিজ ব্রাহ্মণদের সাহায্যের জন্য থেকে যাচ্ছি। যুদ্ধ করে আজ আমি প্রাণ দেব। কন্যা দ্রৌপদীর আজ যা পরিণতি, আমারও তাই হোক। 

ধৃষ্টদ্যুম্ন রেগে বলে –লজ্জা করে না এমন উক্তি করতে! বোনকে যুদ্ধের মাঝে ছেড়ে পালাবো! এমন ভাবে প্রাণে বেঁচে কি লাভ। কি ভাবেই বা অন্যদের মুখ দেখাবো। আমি আজ মারবো ও মরবো- এই যুদ্ধে। তুমি গিয়ে অন্তপুরবাসিনীদের রক্ষা কর। 

পুত্রের কথা শুনে দ্রুপদ বলেন –কৃষ্ণা এই আজ্ঞা পাঠিয়েছে। যবে থেকে কৃষ্ণা আমার ঘরে এসেছে আমি তাঁর সকল কথা শুনে চলি, কখনও লঙ্ঘন করি না। বৃহস্পতির চেয়ে বেশি বুদ্ধি ধরে আমার শশিমুখী এই কন্যা। যার মন্ত্রণাবলে আজ রাজ্যে আমি সবচেয়ে সুখী। কৃষ্ণা যুদ্ধ করতে বারণ করেছে। সেজন্যই তোমাদের আমি যুদ্ধ বন্ধের নির্দেশ দিচ্ছি। 

ধৃষ্টদ্যুম্ন বলে –তোমরা ঘরে যাও। কৃষ্ণাকে রক্ষার জন্য আমি এখানে আছি। 

এভাবে প্রবোধ দিয়ে ধৃষ্টদ্যুম্ন সকলকে ঘরে ফিরিয়ে আবার যুদ্ধের মাঝে ঝাঁপিয়ে পরল। কীচকের সাথে তাঁর সাঙ্গাতিক যুদ্ধ হল। গদাঘাতে কীচক ধৃষ্টদ্যুম্নের রথ ভাঙ্গল। গদার প্রহারে সে জ্ঞান হারাল। হাত থেকে ধনুর্বাণ খসে পরল। নিরস্ত্র, বিরথী হল দ্রুপদ নন্দন। দ্বিজগণের মাঝে পড়ে সে প্রাণে বাঁচল। 

অন্যদিকে দ্রৌপদী কেঁদে বিলাপ করতে থাকেন –না জানি আমার বৃদ্ধ পিতার কি হল। মা-ভাইদেরই বা কি অবস্থা। 

তিনি বিলাপ করছেন দেখে ধনঞ্জয় বলেন –কি কারণে কাঁদছেন, দেবী, কি আপনার ভয়! 

কৃষ্ণা বলেন –আপনাদের দোষ দিই না। আমার কারণেই সবংশে আমার পিতা বিপদে পড়লেন। 

পার্থ বলেন –দুঃখ করে আর কি হবে। গোবিন্দের স্মরণ করলে সকল বিপদ থেকে মুক্তি পাবেন। তিনিই এ মহাবিপদ সিন্ধু পার করে দেবেন। তাকেই স্মরণ করুন যাজ্ঞসেনী। 

অর্জুনের কথায় কৃষ্ণা জগন্নাথকে স্মরণ করেন –হে কৃষ্ণ, আপদহর্তা! রক্ষা কর আমায়। তুমি ছাড়া আর কেউ আমায় রক্ষা করতে পারে না। আমাকে বিপদে রক্ষা কর, নারায়ণ! পিতা, মাতা, ভাইদের রক্ষা কর, দেশের রাজ্যের প্রজাদের প্রাণ রক্ষা কর। আমি যদি সতী হই তবে তোমায় আমার কথা রাখতেই হবে। সবাইকে জিতে আমার ব্রাহ্মণ স্বামী আমায় পেয়েছেন। 

দ্রৌপদীর বিপদ জেনে জগন্নাথ অভয় দিয়ে বাম হাত তুললেন। 
দ্রৌপদীকে আশ্বাস দিতে পাঞ্চজন্য বেঁচে উঠল। সেই শব্দে সকল সৈন্য স্তব্ধ হল। 
সব যদুবীরদের ডেকে গোবিন্দ বলেন –দেখ অর্জুনকে রাজারা ঘিরে ধরেছে। ওদিকে সৈন্যরা যথেচ্ছ ভাবে নগরে ভাঙ্গচুর চালাচ্ছে। তোমরা গিয়ে যত্নের সঙ্গে পাঞ্চালনগর রক্ষার ব্যবস্থা কর। 

শুনে সাত্যকি, গদ, প্রদ্যুম্ন, সারণ প্রমুখ যদুবীর গর্জন করে বলে –ইনি যদি কুন্তীপুত্র ধনঞ্জয় হন, যিনি আপনার প্রিয় বন্ধু, সংসারে সবাই জানে। এই মহা সঙ্কটে যিনি একা পরে গেছেন। আপনি আজ তাকে সাহায্য করুন বা না করুন আমরা তাকে রক্ষা করে শত্রুদের ক্ষমা করব না। সব ক্ষত্রিয়দের মেরে পান্ডবদের রক্ষা করব। এত বলে সবাই যুদ্ধ করতে উদ্যত হল। 

বাসুদেব বহু প্রবোধ দিয়ে তাদের আটকে বলেন –আমি সহজেই ক্ষত্রিয়দের মারতে পারতাম। কিন্তু বলরাম নিষেধ করেছেন। তাঁর আজ্ঞা লঙ্ঘন সম্ভব নয়। আর অর্জুনের পরাক্রমও সকলে বুঝুক। পৃথিবীর সবাই এক হয়েও আজ অর্জুনকে হারাতে পারবে না জেনে রাখ। অর্জুনের কারণে দুঃখিত হয়ো না। এখন তোমরা গিয়ে পাঞ্চাল নগর রক্ষা কর। 

কৃষ্ণের বচনে সব যাদব ভূপাল পাঞ্চাল নগর রক্ষার জন্য গেল। প্রতি ঘরে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাহারা দিয়ে সৈন্য নিবারণ করে প্রজাদের রক্ষা করল। 

দেবী কুন্তী যে কুম্ভকারের কর্মশালায় আশ্রয় নিয়েছিলেন সেটি রক্ষার জন্য স্বয়ং গোপাল ও বলরাম গেলেন। 
................................... 

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers