Blog Archive

Thursday, August 20, 2009

আমার চোখে ছেলেরা (স্মৃতি থেকে)

আজ আবার একটু গল্প করতে ইচ্ছে করছে। আজ শুরু করি আমার ভাই বাপ্পা আর তার খরগোসের গল্প দিয়ে।

বুলবুলি থাকতেই বাপ্পা দুটো খরগোস আনে। সারাদিন তাদের নিয়ে কাটে।

বাপ্পার কথা একটু এখানে বলে নিই। ছোটবেলা পড়ার জন্য দাদুর কাছে খুব মার খেত। চান করতে চাইত না, চ্যাং দোলা করে নিয়ে চৌবাচ্চায় চোবান হত। কান টেনে টেনে বুদ্ধদেবের মত হয়ে গেছিল।
হাঃ...হাঃ...এসবই আমার খুব ছোটবেলার স্মৃতিতে বাপ্পা। আর খুব বোকা ছিল। আমি কিছু অন্যায় করলে ওর ঘাড়ে চাপাতাম। আত্মীয়দের মুখে শুনি বাপ্পাটা ছোটবেলায় খুব দুষ্টু আর গুন্ডা টাইপের ছিল। ও আসবে শুনলে নাকি সব সৌখিন জিনিষ উঁচুতে তুলে রাখত। হোস্টেলে মাঝে মাঝে বাপ্পা যেত। গোল টাইপের ছিল, তাই দিদিরা আদর করত।
তারপর আমি যখন জলপাইগুড়ি গেলাম, তখন আমরা একবছর একসাথে থাকি, সারাদিন মারামারি করতাম। ওর সাথে পারতাম না। কামড়ে দিতাম, পাপাকে দিয়ে খুব মার খাওয়াতাম। একটু ভেবলা গোছের ছিল। মনে আছে ও জেলা স্কুলে পড়ত। একটা লাইন ও পড়ছে এখনও কানে বাজে “বেগুনগাছে জল দিচ্ছে!...(প্রায় পাঁচ মিনিট পস্‌, তারপর).........কেষ্ট!!” ...হাঃ...হাঃ, এখনও ক্ষেপাই ওর সেই পড়ার বহর শুনিয়ে।

ওকে পাপা সিউড়ি রামকৃষ্ণ মিশনে দিয়ে দিল। প্রথম প্রথম খুব কমই বাড়ি আসত। ছুটিতে কলকাতায় চলে আসত। সে সময় আমরা ওকে হোস্টেলে দেখতে গেলাম। আমাদের দেখে লুকিয়েই পড়ল! তারপর ওর ঘরে গিয়ে দেখলাম আপন মনে ছবি আঁকছে। বাপ্পা হোস্টেলে আমার চেয়ে অনেক বেশিদিন ছিল। ওখানে গিয়েই ঢেঙা হয়। না হলে ছোটবেলা আমার চেয়ে বেঁটে ছিল, খুব থাব্‌ড়ে-থুবড়ে রাখতাম।

হি...হি, ছেলেবেলা বাপ্পাকে কত সাজাতাম! এই লেখাটা ও পড়বেনা এই বাঁচোয়া! ওকে দু’দিকে ঝুঁটি বেঁধে, শাড়ি পড়িয়ে ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়েও খেলেছি। আমি, টিয়া আমার খুড়তুতো বোন আর বাপ্পা পিঠোপিঠি ছিলাম। বাড়ির বাইরে কারো সাথে মেলেমেশা দাদু পছন্দ করত না। আমি তাই ওদের হেড হয়ে ওদের উপর খুব তড়পাতাম। ওদের দু’জনের আবার খুব ভাব, বরাবর।

বাপ্পাটা এত বছর হোস্টেলে ছিল, কিন্তু আমার মত কোন আবেগই নেই! আশ্চর্য! কারণ হয়ত ছেলেরা বেশি প্রকাশ করতে পারে না, মেয়েদের মত। কেননা, জিজ্ঞেস করলে দু’একটা ছারাছারা হোস্টেলের কথাও বলে।

আমার হায়ারসেকেন্ডারী পরীক্ষার পর বাপ্পা একদম জলপাইগুড়িতে ফিরে এলো। এতে আমার খুব ভাল হল। তার আগে আমি বড্ড একা একা থাকতাম। বাপ্পা আসল, কত কিছুতে ভর্তি হল, সঙ্গে আমিও। তারপর থেকে আমরা খুব টাউনে যেতাম। প্রথম প্রথম দু’জনেই রিক্সায় যেতেম, পরে বাপ্পা সাইকেল কিনল। পাপা পাপার লুনায় আমায় প্যাডেলিং সেখানোর অনেক চেষ্টা চালায় হোলি চাইল্ড স্কুলের বড় গলিতে। রেগে গেলে পাপা খুব চ্যাঁচাতো, আর আমার মেরিট সব জায়গাতেই ভিষণ লো! ফলে আর সাইকেল শেখা হল না। তবে সোমার সাইকেলের পেছনে বসে ওর সাথে কলেজে ওঠার পর খুব টো-টো করে ঘুরেছি।
হোস্টেল থেকে ফিরে এলো এক অন্য বাপ্পা। ছোটবেলা যেমন দুরন্ত ছিল, এখন তেমনি শান্ত। বাড়ি আছে কি নেই বোঝার যো নেই! বাপ্পা তখন সারাদিন টিভি দেখছে, নয় বড় বড় ছবি আঁকছে। আমিও বরাবর ছবি আঁকি, তবে খাতায়। ও বড় বড় চার্টপেপারে ছবি আঁকছে, দেখে পাপা খুব খুশি হত। পাপাই বড় ক্যানভাস, কত্তো রঙ কিনে আনল। পাপা বাপ্পার ভেতর একজন শিল্পীকে দেখত।

আমাদের বাড়ি আর আত্মীয়দের মধ্যেও জীবজন্তু পোষার একটা চল আছে। বরাবর দেখছি বাড়িতে কুকুর। দামি কিছু না! এমনি, দেশী। জলপাইগুড়িতে আমাদের ভুলো ছিলেন! বাপ্পা এসে দুটো খরগোস আনল। তবে বেশিক্ষণ কোন কিছু নিয়ে থাকত না। বুলবুলি যাবার ক’দিন পর ওর খুব আদরের ধপ ধপে সাদা মেয়ে খরগোসটা চারটে ছানা দিল। কিন্তু বাচ্চাদের খাওয়ায় না। বাপ্পা পশু হাসপাতাল থেকে কি ভাবে মার দুধ বাচ্চাদের খাওয়াতে হবে দেখে এসে তাদের দায়িত্ব আমার উপর ছেরে দিল। মা খরগোসটা বেশ দুর্বল ছিল। বাপ্পা কেবল তাকেই দেখত।
একদিন সামনের বাগানে তাকে ঘাস খাওয়াচ্ছে, একটু অসতর্ক ছিল আর বাইরে আমাদের কালু –যার কথা আলাদা ভাবে না বললেই নয়- সে বড় গেটের ফাঁক দিয়ে মা খরগোসটাকে খপ্‌ করে ধরেই দে ছুট!


আমি যেহেতু ছোটবেলা একা একা বেশ কিছুটা সময় কাটাই, তাই আমার চারপাশে যারা থাকত তাদেরও মানুষের মতই মনে হত। যেমন কালুটা ভিষণ চ্যাংড়া গোছের ছিল। আমাদের খুব ভালবাসত। মাঠে গরু কি ছাগল চরছে! কালু গিয়ে তার ঠ্যাং কামড়ে ধরল, তার তখন খেলতে ইচ্ছে করছে। আমি উপরে ছাদ থেকে দেখতাম। কিন্তু যার পোষ্য, সে তো তা বুঝবে না! সে কালুকে মারতে দৌড়ল, কালু তাতেও মজা পেল। ধরা-ধরি শুরু হল। এবার কালুকে ধরে যেই পিটতে যাবে আমি তখন উপর থেকে বারণ করতাম, বা নিচে নেমে গিয়ে কথা বলতাম। বোঝাতাম ও কামড়েছে কিন্তু দেখ দাঁত বসাই নি, কারণ ও ওদের সাথে খেলতে চায়। কেউ কেউ শুনত, কেউ বা হুমকি মেরে যেত। আমদের ভুলো বেশ লাটসাহেব ছিল। খুব ফেলে ছরিয়ে খেত। আমি এক রকম ওর পিছন পিছন ঘুরতাম খাবার নিয়ে, দয়া করে একটু খেলেন! যা পরে থাকত তা গেটের নিচ দিয়ে বাইরে সাপ্লাই করতাম, কালু চেটে পুটে খেত। বাড়িতে রুটি হচ্ছে! দু-চারটে কালুকে দিয়ে আসতাম। বাপ্পাও দিত। বাপ্পা-পাপাকে রাস্তায় পেলে ও পায়ে লুটিয়ে পরত। বাপ্পাও কালুকে ভালবাসত। ভুলোটা একটু গম্ভীর ছিল, কালুটা খুব জলি ছিল।

তো, মা খরগোসটাকে কালু বল –টল ভেবেই তুলে নেয় বলে আমার ধারনা। কিন্তু সেটা যেহেতু খুব দুর্বল ছিল, তাই হয়ত সঙ্গে সঙ্গেই সে মারা যায়। এদিকে বাপ্পা বুঝতে পেরেই কালু-কালু করে ওর পেছনে দৌড়েছে! কালুও মাঠে দে-দৌড়! আমি-ভুলো বাপ্পার আর্তনাদ শুনে দৌড়ে বাইরে এসেছি। খানিক্ষণ পরে বাপ্পা মা খরগোসটাকে নিয়ে বাড়ি ফিরল। কি বলব! সেই প্রথম এত বড় একটা ছেলেকে বাচ্চাদের মত ফুঁপিইয়ে ফুঁপিইয়ে কাঁদতে দেখলাম। কিছুতেই তাকে শান্ত করা যায় না। দেখে আমি প্রচন্ড হক্‌চকিয়ে যাই। বাপ্পা তখন বোধকরি ক্লাস নাইনে পড়া একটু রাগী টাইপের ছেলে। তারপর কোনদিনও বাপ্পা কালুকে ক্ষমা করতে পারিনি। কালুকে দেখলেই মারত। তবু কালু ওর পায়ে শুয়ে গড়াত। আমি বলে বলে মারাটা বন্ধ করি, কিন্তু আর কালুকে বাপ্পা আদর করত না। সরিয়ে চলে যেত। এক বার মজা করে সেই প্রসঙ্গ তুলেছিলাম। কিন্তু এখনও বাপ্পা সেই শোক ভুলতে পারেনা। মুখ উদাস হয়ে যায়। আর তুলি না সে কথা।

বাপ্পার এই আশ্চর্য কোমল দিকটা আমার আরো কিছু স্মৃতিকে জাগ্রত করে। তখন হোস্টেলে থাকি। ছুটিতে জলপাইগুড়ি এসে-ছুটি শেষে ফিরছি। পাপার সাথে দার্জিলিং মেলে ফিরতাম। রাতটা ট্রেনে খুব ভাল লাগত, চাঁদটা প্রায়ই সঙ্গে সঙ্গে থাকত। ট্রেনে ওঠার আগে একবার চাচা চৌধুরী কমিকস কিনেছি। ট্রেনে আবার বই ফেরি করছে, তো পাপা ভাল গল্পের বই কিনে দিল। তখনও গল্পের বইয়ের নেশা হয়নি, বরং বই মানে আতঙ্ক, এটাই জানতাম। তাই মুখ ব্যাজার করে ফাউ হিসাবে আরেকটা চাচা চৌধুরীর দাবি জানালাম। এবার পাপা আর দিল না। আমার রাগ হল খুব। কিন্তু কেউ যেহেতু আমার রাগের ধার ধারত না, তাই আমি রাগ হলে দেখাতাম না, গুম মেরে থাকতাম। পাপা আবার মা-মা গোছের। ট্রেনে জল খাও, খাবার খাও করেই চলেছে! আমিও সুযোগের সদ-ব্যাবহার করলাম। গোজ হয়ে বসেই আছি! পাপা পরল ফাঁপরে! শেষে পাশের প্যাসেনজাররাই দায়িত্বটা নিল।

সেবার আমরা দু-একজনরা ছাড়া পুর বগিটাই ছিল জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পাশ করা ছাত্রে ভর্তি। তাদেরই একজন দাদা আমায় তাদের ওদিকে নিয়ে গেল। তারপর তাদের সাথে সাথেই কেটে গেল পুর পথ। সেই দাদাটা কত গল্প বলেছিল। একটা এখনও মনে আছে ‘মধুসূদন-দাদা’র গল্প। এত বিশ্বাস হয়েছিল যে পরীক্ষায় কিছুই চিনতে না পেরে খুব তার নাম আউরে ছিলাম, মনে আছে। আর একজন ছিল-গিটার নিয়ে টং-য়ে বসে মাথা নেড়ে নেড়ে গান করছিল সারাক্ষণ। সবাই আমায় এত্তো চকলেট দেয় ওই লোকটা ছাড়া। মনে আছে বড় বড় চুল, রোগা, লম্বা-রাগী রাগী দেখতে। পরেরদিন কলকাতার কাছাকাছি আসতেই দাদাগুলোর মুখ করুন হতে লাগল। শেষে এক এক করে নেমে যাচ্ছে, সবাই জড়িয়ে ধরছে। সেই প্রথম ছেলেদের কাঁদতে দেখি। ছোটবেলা থেকেই আমাদের একটা ধারণা ছেলেরা কাঁদে না। ফলে এত্ত বড় বড় ছেলেদের কাঁদতে দেখে খুব মজা পেয়ে জিজ্ঞেস করি- এমা! তোমরা কাঁদছ কেন! ছেলেরা আবার কাঁদে নাকি? তখন কেউ একজন বলেছিল তুমিও যখন হোস্টেল ছেরে, বন্ধুদের ছেরে চলে যাবে তখন দেখবে সবাই তোমার জন্য কাঁদবে, তুমিও বন্ধুদের জন্য দুঃখ করবে! মনে আছে সেই রাগী ক্ষেপাটে দাদাটাই সবচেয়ে বেশি দুঃখ পেয়েছিল। এর থেকে মনে হয় ছেলেরা বাইরে যতই চোটপাট করুক আসলে অনেকক্ষেত্রে মেয়েদের চেয়েও কোমল মনের হয়।

সেবার আমি এত্তো ক্যাডবেরি পাই যে কলকাতার বাড়ি-পিসির বাড়িতে সবাইকে দিয়েও হোস্টেলে অনেককে চকলেট-মুখ করাই।

Friday, August 7, 2009

আমার লেজ ব্যাঁকা বুলবুলি

অনেকদিন পর আবার বুলবুলি!

সে অনেকদিন আগের কথা...তখন থাকতাম জলপাইগুড়ি......আমাদের একতলা বাড়ির সামনে-পিছনে অনেক জায়গা ছিল......নারকেল, সুপারী, পেয়ারা, আম, জাম, লিচু, জলপাই, কলা, পেঁপে, সাদা চন্দন, নিম, গাবগাছ যেমন ছিল। তেমনি ছিল, জবা, স্থলপদ্ম, গন্ধরাজ, গোলাপ, শিউলি, ধুতরা, কফি, দারচিনি, ছোট এলাচ, গোলমরিচ গাছ।

এ সবই আমার বাবা-দাদুদের সখ, বাবা মানে পাপার সখ বিশেষ করে......বাড়ির বেশি বয়স ছিল না...মাত্র ১৫-১৬ বছর...আমি থাকি ১২বছর...গাছগুলিও পরে লাগান......ফলে সব ছেরে যখন আসছি তখন তারা বড় হচ্ছে......আমার প্রিয় নিমগাছ, এখন নিশ্চয়ই বৃক্ষ.........পাপার প্রিয় ছিল সাদা চন্দন গাছ।

এক রবার গাছটা কলকাতায় এসে টিকেছে...কিন্তু বড় বড় কৃষ্ণচূড়ার সাথে
এখনো লড়াইয়ে পেরে উঠছে না...তাই একদম বাড় নেই।

জলপাইগুড়িতে যে সাজান বাগান ছিল, তা নয়, গাছগুলোও আমার মতই আপন খেয়ালে বারত।
এত গাছ বলে পাখির আনাগোনা খুব ছিল।

ওখানের স্মৃতিতেই প্রথমেই আসে বড় বড় দাঁড়কাক......সকালে বাড়িতে বাসি রুটি কাকদের দেওয়ার চল আছে।

বড় বড় দাঁড়কাক তাদের ছানাদের নিয়ে আসত। সে একটা দেখার জিনিষ! ছানারা অধিকাংশ বাবা-মার মত কিন্তু মাঝে মাঝেই ব্রাউন ব্রাউন মার চেয়ে সাইজে বড় ছানাও আস্ত! সেগুলি চিলের ছানা। কিন্তু মা কাক পরম মমতায় তাকেও খাওয়াত। কাক অত বোকা নয়, সে কি বুঝত না এটা তার ছানা নয়! তবু দেখেছি মা কাক তার চিল-ছানার জন্য অন্য কাকের সঙ্গে লড়ছে।


জলপাইগুড়িতে বর্ষা ছিল মজার। তখন স্কুলে পড়ি, খুব বৃষ্টি হলে স্কুল ছুটি, কিন্তু ওখানে রাতে দেদার বৃষ্টি হত, দিনে আকাশ পরিষ্কার। তখন ঘুম থেকে উঠেই ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে’ মনে মনে গাইতাম। তবু বৃষ্টি হত না। রিক্সা আসত, মুখ ব্যাজার করে স্কুল যেতাম। স্কুলে বন্ধুদের পেয়ে আনন্দ হত, পড়া ধরলেই আবার মুড খারাপ হত।

একবার এরকম বর্ষায় পরীক্ষা শুরু হবে। সারা বছর অনেকের মতই বিনদাস থাকতাম। পরীক্ষার আগে রাত জেগে পড়া চলছে। ভোরে কাজের ছেলেটা এসে বলল, পিছনে পেয়ারা গাছে একটা পাখির বাসা ছিল, সেটা পরে গেছে। তার ক’দিন আগে একটা বিড়ালছানা নিয়ে একটু অশান্তি হয়ে গেছে, নাক-কান মুলেছি এসব আর না, মন দিয়ে পড়ে মানুষ হব। ওকেই বল্লাম, তুই যা পারিস কর। দুপুরে বেরনো ছিল। সন্ধেবেলা ফিরে কি মনে হল, খবর নিলাম। বলল বাসাটা গাছে তুলে দিয়েছে।

পরদিন ভোরে এমনি পেছনের বাগানে গেলাম। পিছনের জমি নিচু, জল জমে। রুটি দেওয়ার সময়ও লক্ষ করলাম পেয়ারা গাছের দিকে কোন পাখিকে দেখছি না। মনটা খচ্‌-খচ্‌ করছে। শেষে পাপা অফিস বেরলে ছেলেটাকে নিয়ে দেখতে গেলাম। বাচ্চা ছেলে, বাসাটাতে প্লাস্টিক দিয়েছিল। জল ভরে গেছে। ৩টে বাচ্চার মধ্যে একটি মারা গেছে, ২টির তখনও প্রাণ আছে।

২টিকে নিয়ে ঘরে এলাম। বাচ্চা দুটির চোখও ফোটেনি। পাখির ছানার যতক্ষণ পালক না হয় দেখতে ভাল লাগেনা, কেমন একট্টূখানি লাল মাংস। বাপ্পা মাটি খুঁড়ে অনেক কেঁচো তুলে দিল।

এদিকে দু’দিন পর থেকে পরীক্ষা। পাপা বাড়ি ফিরে খুব বকা-বকি শুরু করল। আর এত্ত ছোট্ট পাখি হাতে বেশিক্ষন নিলে নোনা লেগেও মারা যেতে পারে। শেষে এক বুদ্ধি বার করলাম।

পরদিন পাখিদের রুটি দেওয়ার সময় একটা মোড়ায় ছোট্ট ঝুরিতে ছানা দুটিকে একটা গাছের নিচে রাখলাম। কাকেরা যাতে না ঠোঁকরায় সেটাও লক্ষ রাখছি। ছানা দুটো...চিঁ-চিঁ করছে!

কিছু পরেই দুটো বুলবুলি কিচিমিচি করে তাদের কাছে ঘুর ঘুর শুরু করল। এদিকে মানুষ দেখেই পালায়! বাড়িতে ভুলো আছে। সে বাগানে ঘুরবে! কি করি! বাপ্পা-আমি বুদ্ধি বার করলাম।
মা-বাবা যখন খাবার খোঁজে যাচ্ছে তখন মোড়াটা একটু একটু সরিয়ে আমাদের সিড়ির নিচে আনলাম। অন্ধকার হতে ঝুরিটা সিড়ির নিচে টাঙিয়ে দিলাম। যায়গাটা মাদুর দিয়ে ঘেরা হল -ভুলোর জন্য। তিনি বাড়ির আনাচে-কানাচের খবর রাখেন আর সবাইকে খুব বকেন!

পরেরদিন থেকে ভোর ৩-৪টে নাগাদ বাচ্চাগুলোকে ওখানে রেখে আসতাম। সারাদিন বাবা-মা খাওয়াতো, সন্ধেবেলা তুলে আনতাম।

এর মধ্যে একদিন যেটার স্বাস্থ্য ভাল সেটা ছট–ফট করছে, ধরতে গিয়ে হাত কাটল। শেষ পরীক্ষার আগের দিন সেটা আমারই সামনে বাবা-মার সাথে উড়ে চলে গেল। আমি আড়াল থেকে দেখলাম। বাবা-মা অন্যটাকেও ডেকে ডেকে ওড়াতে চাইল। কিন্তু সেটা ছিল দুর্বল। উড়তে গিয়ে পরে যাচ্ছিল। শেষ পরীক্ষার দিন দেখলাম বাবা-মা একবারও এলো না! বাচ্চাটা খিদেতে কাঁদলো।

আমারও ভাল হল। পরীক্ষা শেষ! সারাদিন ওকে নিয়েই পরে রইলাম।
এবার থেকে আমিই হলাম বুলবুলির বাবা-মা। তার তখন গায়ে হালকা পালক বেরচ্ছে, সারাদিন খিদে। আমি মাথায় পাপার কালো-নরম মান্নাদের মত টুপি পরে থাকি। আর ও তাতে বসে থাকে। সারাদিন বসে থাকে মাথার উপর আর খিদেতে চেচাঁয়। আমার তখন পাগল পাগল অবস্থা! দিনরাত ফড়িং খুঁজি। কোনদিন ফড়িং ধরিনি। সেই আমি ফড়িং ধরে ধরে খাওয়াচ্ছি! দিনে ৩০টা পর্যন্ত খেয়েছে। আমি ৩-৪টের বেশি ধরতে পারতাম না। কাজের বাচ্চা ছেলেটা লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে ধরত। বাপ্পা কেঁচোও ধরে দিত। পাপার সাইটে সিকিউরিটিদেরও বলে রাখতাম। এতো করেও সে বুলবুলির পেট ভরাতে পারি না! দু’দিন চানও করতে পারিনি। খুব ভোরে বাতরুম যেতাম।

শেষে একদিন ঘরে ওকে রেখে চান করতে গেছি, জানলাটা খোলা ছিল আর ও তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। ঘর বাইরে থেকে ভেজিয়ে গেছি। বেরিয়ে এসে দেখি কি! সেই মা বুলবুলটা মুখে করে খাওয়ার নিয়ে এসেছে কিন্তু ঝুড়িতে ফুটো ছোট হওয়ায় খাওয়ার অসুবিধা হচ্ছে। বাপ্পা তখন একটা খোঁড়া শালিকের খাঁচা ছিল, সেটাকে ঠিক-ঠাক করে বারান্দায় বসিয়ে দিল। ওর মাও এসে এসে খাওয়াতে লাগলো-আমারওই ভাল হল! দরজা খোলা, খাট থেকেই গল্পের বই পড়তে পড়তে দেখছি মা আর মেয়েকে।

বিকেলে মাথায় নিয়ে বাগানে ঘুরতাম আর শিষ দিতাম। বাবা-মা এসে মাথার কাছে ঘুরত। ছানাকে ওড়ার জন্য ওস্কাত। বাচ্চাটা প্রথম প্রথম বুঝত না। এদিকে একদিন পাপা শুনে এলো পাহাড়ী বুলবুল পোষা মানা, আর ওরা ভুট্টাও খায়। ভুট্টা এলো, ছোলা এলো, মুনিয়া পাখির লাঠিয়া নাকি! এই ছোট ছোট তাও এলো। সব গুঁড়ো করেও খাওয়াছি। আর ভাবছি।

বুলবুলিকে আমগাছের নিচু ডালে বসিয়ে এলে ও ঠিক উড়ে এসে আমার মাথায় বসত। ভোরে ওকে বাইরে বসিয়ে শিষ দিলেই মা-বাবা-ভাই সব চলে আসত। কি সুন্দর ছোট ছোট ফল মুখে করে এনে খাওয়াত। একটা পরে গেলে তুলে খেয়ে দেখেছি-কেমন কষা আর মিষ্টি মিষ্টি মত।

শেষে বুলবুলি বেশ বুঝল ও পাখি। তখন স্বাস্থ্যটাও ভাল হয়েছে। পুরপুরি আমার কাছে ও ২১দিন ছিল। শেষের দিকে সন্ধ্যেবেলা ঘরে তুললে ও কেমন খুনখুন করে কাঁদত। বেশ বুঝতাম ওর কষ্ট হচ্ছে। ও কাঁদছে। ঠিক করলাম ছেরে দেব। প্রতিদিন ওকে অল্প অল্প ওড়ার অভ্যেস করাতাম। যদি ও একটু উল্টো-পাল্টা উড়ত, তো আমার প্রাণও উড়ে যেত।

শেষের আগের দিন উড়ে পাশের বাড়ি ডোবায় একটা কুল গাছের ঝোঁপে আটকে গেল। ওর বাবা-মা ওকে যে দিকে উড়তে বলে তার উল্টো দিকে গিয়ে এই অবস্থা! আমি পড়ি-মড়ি করে পাশের বাড়ি ছুটলাম। কিছুতেই ওর কাছে যাওয়া যাচ্ছে না! পাক মত হয়ে আছে! ঢুকে যাছি! একেক্কার অবস্থা! শেষে বাপ্পা পাঁচিল টপকে সেই পাঁকের মধ্যে দাঁড়িয়ে, লম্বা বাঁশের সাহায্যে, অন্ধকার হতে ওকে কুলগাছ থেকে নামিয়ে আনল।

সেদিন কি কান্না বুলবুলির! রাতটা ছিল আজকের মতই পূর্ণিমার- বড় গোল চাঁদ উঠেছে। কাজের মাসি আর ছেলেটা বারান্দায় শুয়েছিল। আমিও ঘরের মাটিতে মাদুর পেতে শুলাম। চাঁদ দেখতে দেখতে ঠিক করলাম –এবার বুলবুলিকে ছাড়তেই হবে। বাড়িতে সবাই তখন বলছে ও উড়তে পারে না, উল্টো-পাল্ট যায়। ডানা দুর্বল! ওকে যেন আর না ছাড়ি। কিন্তু আমি যানতাম ও আকাশে উড়তে চায়।

পরেরদিন ভোরবেলায় আমগাছের নিচু ডালে বসিয়ে শিষ দিলাম। বাবা-মা এলো, খাওয়াতে লাগলো। আমি বাতরুমে চলে গেলাম। এসে দেখলাম ও ডালে নেই- বুলবুলি আমার উড়ে গেছে! দৌড়ে এসে ছেলেটাকে ডাকলাম। অনেক দৌড়াদৌড়ি করলাম। তখন সবে সূর্য উঠছে। শেষে ৮টার সময় ছেলেটা এসে বললো অন্যপাশের বাড়ির কাঁঠালগাছের অনেক উঁচুতে চারজনে বসে আছে।

সেদিন ছিল রবিবার। মনটা আনন্দে ভরপুর - বুলবুলি স্বাধীন। তবু কোথায় যেন ভেতরটা কেঁদে কেঁদে উঠছে! শেষে গানের স্কুলে চলে গেলাম।

সে দিন রাতেও বৃষ্টি হল। কত চিন্তা! বুলবুলি এতদিন জলে ভেজেনি - কি হবে?

ওমা! পরেরদিন পাউরুটি দিয়ে শিষ দিতেই চারজনে হাজির। তারপর কত বসন্ত চলে যাচ্ছে! এখনো নিশ্চয়ই সে বুলবুলি আকাশে উড়ে বেরায়। আজও ওকে দেখে আমি চিনবো। লাল ঝুড়িতে থাকতে থাকতে লেজ বেড়ে যায় কিন্তু ঝুড়ি ছোট –শেষে লেজের পালকগুলো ছোট-বড় হয়ে যায়। আমার লেজ ব্যাঁকা বুলবুলি আজও আকাশে ডানা মেলে ঘুরে বেড়ায়। আমি চোখ বুজে দেখতে পাই।

আশ্চর্য! বুলবুলি উড়ে যাওয়ার ক’দিন পরেই বাপ্পার সাদা খরগোসের চারটে বাচ্চা হয়। সে আরেক গল্প!

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers