Blog Archive

Wednesday, December 28, 2011

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৩৮



বিচিত্রবীর্যের কাহিনী:
সত্যবতীকে পেয়ে রাজা শান্তনু আনন্দিত হলেন এবং তার সঙ্গে অনুক্ষণ ক্রীড়া করেন। দশমাস পর রাণী পরম সুন্দর পদ্মের মত কোমল পুত্রের জন্ম দিলেন। নাম দেওয়া হল চিত্রাঙ্গদ। কয় বছর পর সত্যবতীর দ্বিতীয় পুত্র হল-বিচিত্রবীর্য। এই দুই পুত্রই হলেন পরম সুন্দর, যেন কাম অবতার।

এর কিছুকাল পর শান্তনু দেহত্যাগ করলেন। ভীষ্ম এবং সত্যবতী শোকাকুল হলেন। রাজার মৃত্যুতে প্রজারাও দুঃখী হল। পিতার বিহনে ভীষ্মই দুই কুমারকে পালন করতে শুরু করলেন। চিত্রাঙ্গদকে রাজা করে তিনি রাজ্য শাসন শুরু করলেন।

যুবক বীর চিত্রাঙ্গদ অতিশয় বলশালী ছিলেন। মানুষ, দেবতা, অসুর, গন্ধর্ব সকলকেই নিকৃষ্ট মনে করতেন। একদিন গন্ধর্বরাজ চিত্রাঙ্গদ তাকে বললেন –তোমার ও আমার নাম একই। আমার সঙ্গে যুদ্ধ কর নতুবা অন্য নাম নাও। কুরুক্ষেত্রে সরস্বতী নদীতীরে দুজনের ঘোর যুদ্ধ হল। শেষে গন্ধর্ব নিজ মায়াবলে কুরুনন্দন চিত্রাঙ্গদকে হত্যা করলেন।

ভীষ্ম অপ্রাপ্তযৌবন বিচিত্রবীর্যকে রাজপদে বসালেন। তার যৌবনকাল উপস্থিত হলে বিবাহ দেওয়া স্থির হল। সে সময় কাশীরাজ তার তিন পরমা সুন্দরী কন্যার এক সাথে স্বয়ংবর করছেন শুনে ভীষ্ম মাতা সত্যবতীর আজ্ঞা নিয়ে একাই বারাণসীতে এলেন। স্বয়ম্বরে দেখলেন অনেক রাজা উপস্থিত।


তিনি সকলের উদ্দেশ্যে বললেন –রাজগণ, বহুপ্রকার বিবাহ প্রচলিত আছে। স্বয়ংবরসভায় বিপক্ষদের পরাভূত করে কন্যা হরণ করাও এক পদ্ধতি। আমি ছোট ভাই শান্তনুপুত্র বিচিত্রবীর্যের জন্য এই তিন কন্যা নিয়ে যাচ্ছি। যার শক্তি আছে তিনি যুদ্ধ করুন।

সকল রাজা অস্ত্র নিয়ে তাকে আক্রমণ করলেন। গঙ্গা পুত্র ভীষ্ম, যিনি বশিষ্টের শিষ্য, সকলকে পরাস্ত করলেন। কেউ নিজের প্রাণ হারায় তো কেউ অঙ্গ। সকলে পরাস্ত হয়ে ভীষ্মের জয়গান শুরু করল।
ভীষ্ম তিনকন্যাকে কনিষ্ঠা ভগিনী বা দুহিতার মত যত্নসহকারে হস্তিনাপুরে নিয়ে চললেন। তাকে যেতে দেখে শাল্বরাজ বাধা দিলেন। শাল্বরাজও বীর ছিলেন। দুজনের প্রচন্ড যুদ্ধ হল। ভীষ্ম শাল্বরাজের সারথীর মুন্ডচ্ছেদ করলেন, চার অশ্বকেও হত্যা করলেন, ধনুক কেটে দিলেন। কাতর শাল্বরাজকে কেবল প্রাণদান করে নিজ রাজ্যে ফিরে গেলেন।

হস্তিনানগর রাজা বিচিত্রবীর্যের বিবাহে সেজে উঠল। বিচিত্রবীর্যের বিবাহকাল উপস্থিত হলে তিন কন্যাকে বরের নিকট আনা হল। বড়কন্যা অম্বা তখন জানালেন শাল্বরাজকে তিনি মনে মনে বরণ করেছেন, শাল্বরাজও প্রস্তুত ছিলেন। তার পিতাও এ বিবাহে সম্মত হয়েছিলেন। সব শুনে ভীষ্ম মন্ত্রণা করে অম্বাকে শাল্বরাজের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
অন্য দুই কন্যা অম্বিকা ও অম্বালিকার সঙ্গে বিচিত্রবীর্যের বিবাহ দিলেন।


ওদিকে শাল্বরাজ অম্বাকে আর গ্রহণ করলেন না। কাঁদতে কাঁদতে অম্বা ভীষ্মের কাছে ফিরে এলেন এবং জানালেন ভীষ্ম হরণ করায় শল্ব আর তাকে গ্রহণ করলেন না। ভীষ্মও তাকে গ্রহণে অসম্মত হলেন। তখন ক্রোধে অগ্নিশর্মা অম্বা প্রতিহিংসা নেওয়ার জন্য জগদগ্নিপুত্র পরশুরামের শরণ নিলেন। কাতরা দেখে পরশুরাম অম্বাকে অভয় দিলেন এবং শিষ্য ভীষ্মকে ডেকে তাকে বিবাহ করার জন্য আজ্ঞা দিলেন। গুরু পরশুরামকে ভীষ্ম বিনয়ের সঙ্গে তার ব্রহ্মচর্য পালনের অঙ্গিকারের কথা বলে বিবাহে অপরাগ জানালেন। শুনে ক্রুদ্ধ জামদগ্ন ভীষ্মকে যুদ্ধে আহ্বান জানালেন।

যুদ্ধে কেউই কাউকে পরাস্থ করতে পারলেন না। দেবতাদের মধ্যস্থতায় পরশুরাম ভীষ্মের বিনয়ে তুষ্ট হয়ে তাকে বুকে টেনে নিলেন এবং তার মত শিষ্য পেয়ে গর্ববোধ করলেন। অম্বার কাছে ক্ষমা চেয়ে তাকে নিজগৃহে ফিরে যেতে অনুরোধ জানালেন।

দুঃখিতা অম্বা ভীষ্মবধের উদ্দেশ্যে দুঃসাধ্য ব্রত গ্রহণ করে কঠোর তপস্যা করতে লাগলেন।

অবশেষে মহাদেব তার উপর তুষ্ট হয়ে আশির্বাদ করলেন –তুমি অন্যদেহে পুরুষত্ব পেয়ে ভীষ্মকে বধ করবে, বর্তমান দেহের সব ঘটনাও তোমার মনে থাকবে। মহাদেব অন্তর্হিত হলে অম্বা নবজন্মকামনায় চিতারোহণ করে দেহত্যাগ করলেন।

এদিকে বিচিত্রবীর্য দুই সুন্দরী পত্নীকে পেয়ে কামাসক্ত হয়ে পড়লেন। অম্বিকা ও অম্বালিকা পরমা সুন্দরী, তাদের রূপের কাছে স্বর্গের বিদ্যাধরীরাও হার মানেন। বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে তাদের বিবাহ হল যেন শচী তিলোত্তমা দেবেন্দ্রকে পেলেন। নবীন বয়সে বিচিত্রবীর্য দুই কন্যাকে নিয়ে শৃঙ্গার রসে মত্ত হলেন। অল্পকালে তার যক্ষারোগ ধরল। ভীষ্ম বহু চেষ্টা করলেন কিন্তু আদিত্য যেমন অস্তাচলে যান বিচিত্রবীর্যও সেই রূপে অপুত্রক অবস্থায় যমালয়ে গেলেন। স্ত্রীরা কান্নাকাটি করলেন, সত্যবতীও শোকাতুরা হলেন।

বংশরক্ষার কথা ভেবে সত্যবতী চিন্তিত হলেন এবং ভীষ্মের কাছে গিয়ে তাকে এই বিখ্যাত বংশের অস্তিত্ব রক্ষার অনুরোধ করলেন।
শান্তনুপুত্র ভীষ্ম বলেন –মাতা, ত্রিলোকের সমস্তই ত্যাগ করতে পারি কিন্তু যে সত্য প্রতিজ্ঞা করেছি তা ভঙ্গ করতে পারি না।
সত্যবতী তার কাছে কেঁদে বলেন তিনি সবই জানেন কিন্তু ভীষ্ম ছাড়া তিনি আর কার কাছেই বা যেতে পারেন! ভীষ্মই এখন পথ দেখান।
ভীষ্ম বলেন –কুরুবংশ রক্ষার পথ আছে পূর্বে যখন পিতার কারণে পরশুরাম পৃথিবী থেকে ক্ষত্রিয়দের নির্মূল করেন তখন ক্ষত্রিয় নারীরা ব্রাহ্মণদের ঘরে আশ্রয় নেন। এভাবে পুনরায় ব্রাহ্মণদের সাহায্যে ক্ষত্রিয়বংশ রক্ষা পায়।

.........................................

Sunday, October 2, 2011

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৩৭



সত্যবতীর বিবাহঃ

জন্মেজয় জিজ্ঞাসা করেন –ভীষ্ম পিতামহকে ধীবররাজ কি বলেছিলেন!

মুনি বলেন – দাসরাজ বিনয়ের সঙ্গে দেবব্রতকে বলেন তার পিতা শান্তনুও পূর্বে এসেছেন।

দাসরাজ বলেন -তোমার পিতা কামদেবের তুল্য, বিখ্যাত কুরু কূলপতি। তাকে কন্যা দেওয়া ভাগ্যের ঘটনা। কিন্তু অভয় দিলে কিছু নিবেদন করি।

দেবব্রত বলেন তিনি নির্ভয়ে সকল কথা বলুন, সাধ্য হলে অবশ্যই তিনি তা দান করবেন।

ধীবররাজ বলেন –তুমি রাজার যোগ্য বীরপুত্র কিন্তু পরবর্তীকালে কলহ অবশ্যম্ভাবী। তুমি গঙ্গার পুত্র, দেব-দানব তোমার পক্ষে। তোমার সামনে আমার কন্যার পুত্রদের স্থান কি হবে!

সব শুনে দেবব্রত বলেন -আমি থাকতে আপনার কন্যার কোন দুঃখ হবে না। এখানে আমি সকলের সামনে প্রতিজ্ঞা করছি রাজ্যে আমার কোন অধিকার নেই। আমার পিতা ও আপনার কন্যার গর্ভের সন্তানই রাজ্যভার পাবে।

দাসরাজ বলেন –তোমার বচন অব্যর্থ। কিন্তু আরেকটা নিবেদন আছে। তুমি রাজ্য ত্যাগ করলে কিন্তু তোমার পুত্ররা যদি দ্বন্ধ করে!

দেবব্রত বলেন –আমি যখন রাজ্যভার ত্যাগ করেছি তখন সে ভয় আপনার সঙ্গত নয়। তবু আমি সকলের সামনে প্রতিজ্ঞা করছি বিবাহ করবো না। আজ থেকে আমি ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করলাম, আমার পুত্র না হলেও আক্ষয় স্বর্গ লাভ হবে।

দেবব্রতের এই বাক্যে দেবতা-গন্ধর্ব-নর সকলে বিস্মিত হলেন। ধন্য ধন্য রবে চারদিক পূর্ণ হল। অপ্সরারা স্বর্গ থেকে পুষ্পবৃষ্টি করলেন।


ভয়ঙ্কর এই প্রতিজ্ঞা করার জন্য শান্তনু ও গঙ্গার পুত্রের নাম হল ভীষ্ম।


ভীষ্মের সত্যবচনে মুগ্ধ রোমাঞ্চিত দাসরাজ নিজের কন্যাকে ভীষ্মের হাতে তার পিতার জন্য দান করলেন। সত্যবচন থেকে ভীষ্মের এই জননীকে সত্যবতী নাম দেওয়া হল।

সত্যবতীকে ভীষ্ম যোড়হাতে বলেন –মাতা রথে উঠুন এবং নিজগৃহে চলুন।

সত্যবতীকে রথে আরোহণ করিয়ে ভীষ্ম হস্তিনানগরে প্রবেশ করলেন। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র সকলে দেখতে এলো। সকলে ধন্য ধন্য করল। “ভীষ্ম, ভীষ্ম” রবে ভুবন পূর্ণ হল।


ভীষ্ম সত্যবতীকে নিয়ে পিতা শান্তনুর সামনে উপস্থিত হলেন। সকল ঘটনা শুনে শান্তনু বিস্মিত হলেন এবং তুষ্ট হয়ে পুত্রকে বর দিলেন –তুমি যতদিন বাঁচতে ইচ্ছা করবে ততদিন তোমার মৃত্যু হবে না, তোমার ইচ্ছা মৃত্যু হবে।

ভীষ্মের জন্ম এবং কর্ম আর গঙ্গার চরিত্রের অপূর্ব কথন যে শোনে তার শরীর নির্মল হয় এবং জ্ঞান তত বাড়ে।

.........................................

Tuesday, June 7, 2011

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৩৬


মৎস্যগন্ধার উৎপত্তিঃ
বিশ্বম্পায়ন জন্মেজয়কে বলেন –মাছের গর্ভে এই ব্যাস জননীর জন্ম এবং তিনি পরাশর মুনির দয়া লাভ করে সুগন্ধী হন।

দ্বাপর যুগে এক ধার্মীক সত্যশীল রাজা ছিলেন–পরিচয়। তিনি সবকিছু ত্যাগ করে বনে কঠিন তপস্যা শুরু করেন। শিরে জটা, বৃক্ষের বাকল(ছাল) পরিধান, কখনও ফল-মূলাহার করেন, কখনও বা কেবল জল। কখনও গলিত পত্র, কখনও কেবল বাতাস-এভাবে রাজা অনাহারে তপ করতে থাকেন।


গ্রীষ্মকালে চারদিক যখন জ্বলছে তখন রাজা উর্দ্ধপদে তপ করেন। তার তপ দেখে ইন্দ্র ভয় পেলেন এবং ঐরাবতে চেপে রাজার কাছে উপস্থিত হলেন এবং অনুনয় করলেন তপ ভঙ্গের।


শেষে তাদের বন্ধুত্ব হয়। ইন্দ্র নিজের গলার বৈজয়ন্তীমালা খুলে রাজার গলায় পরালেন। তাকে স্ফটিকময়(স্বচ্ছ ও শুভ্র প্রস্তর বিশেষ)বিমান ও একটি বংশদন্ড দিয়ে ইন্দ্র চেদি রাজ্যের রাজা করে ফিরে গেলেন।

রাজা পরিচয় অঘ্রাণ মাসে উৎসব করে সেই দন্ড রাজপুরীতে এনে ইন্দ্রপূজা করলেন। পরেরদিন নানা অলংকারে সজ্জিত হয়ে চেদিরাজ পরিচয় নিয়ে নানা দান, যজ্ঞ করলেন। শেষে অযোনিসম্ভবা এক কন্যা গিরিকাকে পর্বতে দেখতে পেলেন এবং সেই পরমাসুন্দরীকে বিবাহ করলেন।

রাজা স্ত্রীর সঙ্গে নানা ক্রীড়া করে আনন্দে দিন কাটান। কিছুকাল পর ঋতুকাল এলে ঋতুস্নান করলেন পাটেশ্বরী এবং দান ধ্যান করে পবিত্র হলেন।

সেদিন মৃত পূর্বপুরুষরা স্বপ্নে রাজাকে বললেন মৃগ মাংসের শ্রাদ্ধ কর।
পিতৃগণের আজ্ঞা পেয়ে পরিচয় মৃগয়া করতে অরণ্যে গেলেন। কিন্তু ঋতুমতী স্ত্রীর কথা কিছুতেই ভুলতে পারলেন না। মৃগয়া করতে তার মন লাগে না। সব সময় স্ত্রীকে তিনি স্মরণ করেন। এভাবে কামের উত্তেজনায় তার বীর্য স্খলিত হল। দেখে রাজা চিন্তিত হলেন। হাতে তার পোষা পাখি ছিল। একটি পাতায় বীর্য দিয়ে পক্ষীকে তার পাটেশ্বরীর কাছে প্রেরণ করলেন। পাখি রাজার আজ্ঞায় উড়ে চললো। পথে আরেক পাখি খাদ্যদ্রব্য ভেবে তা কেড়ে নিতে গেল। দুই পাখির যুদ্ধ শুরু হল। এদিকে পাতাটি আকাশ থেকে যমুনা নদীতে পড়ল।

দীর্ঘিকা নামে এক স্বর্গের বিদ্যাধরী(গায়িকা) মুনিশাপে মাছরূপে যমুনা নদীতে অবস্থান করত। সে ঐ বীর্যটি ভক্ষণ করল। দশমাস পর ধীবরের জালে মাছটি ধরা পড়ল। কূলে এসে মাছটি প্রসব করে মুনিশাপ মুক্ত হয়ে নিজ দেশে গেল।

ধীবররা দেখল একটি পুত্র ও একটি কন্যা। তারা অবাক হল। ধীবররাজ সন্তান দুটি নিয়ে চেদিরাজের কাছে গেলেন। অপুত্রক রাজা সন্তান দুটি দেখে আশ্চর্য হলেন। পুত্রটিকে নিয়ে কন্যাটিকে ধীবর রাজাকে দিলেন। পরে পুত্রটি মৎসরাজ রূপে নাম করেন।

কন্যাকে নিয়ে ধীবররাজ নিজ গৃহে আসলেন এবং বহু যত্নে তাকে পালন করতে লাগলেন। নাম হল তার সত্যবতী।

রূপে তার সমান কেউ নেই। কিন্তু কন্যার দুর্গন্ধে কেউ তার কাছে যায় না। সে জন্য তার অন্য নাম মৎসগন্ধা। ধীবররাজ চিন্তিত হলেন। ভাবলেন যমুনা নদী দিয়ে কত মুনি যাতায়াত করেন।
কন্যাকে বললেন –ধর্মের কারণে তুমি পার কর মুনিদের।
পিতৃ আজ্ঞায় কন্যা সেখানে থাকে এবং মুনিদের পারাপার করে।

মহামুনি পরাশর, যিনি শক্ত্রির পুত্র, তীর্থযাত্রা করতে গেলে হঠাৎ সেই পথে যান এবং কৈবর্তের সুন্দরী কন্যাকে দেখে মোহিত হন।

তিনি বলেন –সুন্দরী, নৌকার কর্ণধার কোথায়!

কন্যা বলেন তার পিতা দাস রাজা। পুত্র না থাকায় তিনিই সকলকে পার করেন। তার নাম মৎস্যগন্ধা।

নৌকায় যেতে যেতে পরাশর বলেন কন্যার জন্মবৃত্তান্ত জানেন। তিনি কন্যার থেকে বংশধর পুত্র কামনা করেন।

কন্যা যোড়হাতে বলেন তিনি নীচজাতির কুমারী। সর্বোপরি তিনি দুর্গন্ধা। তার কাছে মুনি কিভাবে আসবেন। আর মুনি বিবাহ না করলে কন্যা কি ভাবে তাকে কামনা করবেন!

মুনি হেসে বলেন তিনি পরাশর মুনি। তিনি বর দেবেন তাই কন্যার কোন ভয় নেই। মৎসের দুর্গন্ধ দুর হয়ে তিনি পদ্মগন্ধা হবেন। প্রথম যৌবনে তিনি যেমন অনূঢ়া আছেন সর্বদা তিনি এরূপই থাকবেন মুনির আশিষে। কেউ পরিচয় জানতে চাইলে বলবেন তার জন্ম কৈবর্ত্তের ঘরে। মুনির বরে মহারাজই তাকে বিবাহ করবেন।


একথা বলতে বলতে কন্যার দুর্গন্ধ দুর হল এবং তিনি সুগন্ধি হলেন। তিনি গন্ধবতী নামে খ্যাত হলেন। এক যোজন দূর থেকে তার সুগন্ধ পাওয়া যেত তাই লোকে তাকে যোজনগন্ধাও বলত। সুন্দরী কন্যা মুনির বরে অতীব সুন্দরী হয়ে উঠলেন। নিজেকে দেখে কন্যা হরষিত হলেন।

পুনরায় যোড়হাত করে বলেন, মুনির বাক্য খন্ডন হয় না। কিন্তু যমুনার দুই তটে কতো লোকজন, জলেও অগণিত নৌকা, তাই লোক প্রচারিত হতে বাকি থাকবে না কিছুই।

শক্ত্রি-পুত্র পরাশর মহা তপধন। মুহূর্তে তিনি চারদিকে কুজ্ঝটি বা কুয়াশায় পূর্ণ করলেন। যমুনার মধ্যে একটি দ্বীপের সৃষ্টি হল। পদ্মগন্ধা কন্যার সাথে মুনি সেথায় রমণ করলেন।

কন্যা গর্ভবতী হলেন এবং তার গর্ভে বিখ্যাত ব্যাসদেব জন্মগ্রহণ করলেন। দ্বীপে জন্মগ্রহণ করায় তার নাম হল দ্বৈপায়ন। তিনি বেদের চারটি ভাগ করে ব্যাস নামে খ্যাত হন। পুত্র শুক ও বৈশম্পায়ন ও অন্যান্য শিষ্যদের চতুর্বেদ ও মহাভারত অধ্যয়ন করান। তাঁরাই মহাভারতের রচনাগুলি পৃথক ভাবে প্রকাশ করেন।

জন্মমাত্র ব্যাস জননীকে বলেন -আজ্ঞা করুন মা, এক্ষুনি তপোবনে যাই।
কথা দিলেন যখনই জননী ডাকবেন তখনই তিনি উপস্থিত হবেন। জননীর আজ্ঞা নিয়ে ব্যাস তপোবনে তপস্যায় রত হলেন।
..........................................

Monday, May 9, 2011

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৩৫

দেবব্রতের যুবরাজ হওনঃ


গঙ্গার বিরহে শান্তনু কাতর হলেন। সর্বদা স্ত্রীর গুণের কথা ভাবেন। গঙ্গার কথা ভেবেই তার যৌবন গেল। তিনি আর বিবাহ করলেন না। দান, ধ্যান, যজ্ঞ করে জিতেন্দ্রিয়, সত্যবাদী রাজা রাজ্য শাসন করেন। এভাবে কিছু বছর গেল।

একদিন রাজা মৃগয়া করতে ভাগীরথী তীরে যান এবং গঙ্গার কূলে বসে তার রূপ দেখতে থাকেন। হঠাৎ তার দৃষ্টি যায় এক অপরূপ যুবার উপর। কামদেবের মত রূপ, হাতে ধনুঃশর। মহাবীর শরজালে গঙ্গার জল বেঁধে ফেলেন। রাজা দেখেন যুবা গঙ্গায় প্রবেশ করলেন। তিনি চিন্তিত মুখে সেখানেই বসে রইলেন। তাকে দেখে গঙ্গা প্রসন্ন হলেন এবং নারীরূপে রাজার সামনে পুত্রকে নিয়ে আবির্ভূতা হলেন।




রাজাকে ডেকে গঙ্গা বলেন –কি কারণে চিন্তা কর, রাজন! এই তোমার কুমার, নাম দেবব্রত। এর গুণ বর্ণনা করা যায় না। বশিষ্ঠের কাছে এর অস্ত্রশিক্ষা, দেবগুরু-দৈত্যগুরুর সমান এর শাস্ত্র জ্ঞান। অস্ত্রবিদ্যা জানে ভৃগুরাম/পরশুরামের সমান। সংসারে যত বিদ্যা নীতিশাস্ত্র ধর্ম, এ পুত্রের অগোচরে নহে কোন কর্ম। একে তোমার হাতে সপে দিলাম। তুমি একে যুবরাজরূপে অভিষেক করো। এত বলে গঙ্গা অন্তর্ধান হলেন।

পুত্রকে পেয়ে রাজা আনন্দিত হলেন। রাজ্যে এসে শুভক্ষণ দেখে তার অভিষেক সুসম্পন্ন করলেন।
প্রজারা আনন্দিত হল। রাজ্যের ভার যুবরাজের হাতে দিয়ে রাজা মৃগয়া গেলেন।

একদিন রাজা যমুনার তীরে উপস্থিত হলেন। কালিন্দীর তীরে হরিণ খুঁজছিলেন, সে সময় এক অপূর্ব সুগন্ধে সে স্থানের বাতাস আমোদিত হল।
কিসের সুগন্ধ অনুসন্ধান করতে করতে শান্তনু এগিয়ে গিয়ে দেখেন নৌকায় এক পরমা সুন্দরী যুবতী বসে আছেন। তার রূপে চারদিক আলোকিত। কন্যার চোখ দুটি অতি চঞ্চল, বিকশিত পদ্মের মত তার তনু, বচন যেন কোকিলের কুহু তান, কুসুমে করবী ভার সুচারু-সুকেশা।
কন্যাকে দেখে শান্তনু কামে পীড়িত হলেন। এগিয়ে এসে রাজা কন্যার পরিচয় জানতে চাইলেন।
কন্যা বলেন -আমি দাস রাজার কন্যা। ধর্ম রক্ষার্থে পিতা নৌকা বাইতে আজ্ঞা করেছেন।

কন্যার কথা শুনে রাজা দ্রুত কন্যার পিতার কাছে গমন করলেন।

রাজাকে দেখে মীনজীবী(জেলে) ধীবর দাসরাজা দ্রুত উঠে এসে নিজের রত্ন সিংহাসনে তাকে আহ্বান জানালেন। তার আগমনের কারণ জানতে চাইলেন।

শান্তনু তার কন্যাকে বিবাহ করার অনুমতি চাইলেন।

দাসরাজা বলেন যদি তিনি কন্যার যোগ্য হন তবেই তার হাতে কন্যাদান করবেন। শান্তনু কুরুবংশের শ্রেষ্ঠ, তথাপি তাকে কথা দিতে হবে তার কন্যার সন্তানরাই রাজ্যের অধিকার পাবে।

শান্তনু বলেন একাজ তিনি কখনই করতে পারবেন না। কারণ দেবব্রত যোগ্য এবং তার অভিষেকও হয়ে গেছে। এই বলে তিনি সে স্থান ত্যাগ করে চলে যান।


কিন্তু রাজ্যে ফিরেও রাজা মন থেকে সে কন্যার চিন্তা দুর করতে পারেন না। সব সময় তার স্মৃতিতে মগ্ন থাকেন। অধোমুখে মনের দুঃখে দিন কাটান।
পিতার দুঃখে পুত্র চিন্তিত হন। এর কারণ জানতে চান। তিনি জানান পিতার আজ্ঞায় দেব-নর-দানব সকলকে বশ করে তিনি তার মনের দুঃখ দুর করবেন।

পুত্রের কথা শুনে শান্তনু বলেন –তুমি কুরুকূলের একমাত্র সন্তান। কিন্তু তোমার যদি কিছু হয় তাহলে বংশের কি হবে। সে কথা চিন্তা করে আমি দুঃখ পাচ্ছি।

বুদ্ধিমান দেবব্রত পিতার কথা শুনে মন্ত্রীদের কাছে গেলেন।
সব শুনে মন্ত্রীরা বলেন –মৃগয়া করতে গিয়ে রাজা গন্ধকালী কন্যার দেখা পান। কিন্তু তাকে বিবাহ করতে চাইলে দাসরাজা তোমার কারণে কন্যা দিতে চাননি।

এত শুনে দেবব্রত রথে চড়ে দাসরাজার সামনে উপস্থিত হলেন এবং পিতার জন্য তার কন্যাকে প্রার্থনা করলেন।

দাসরাজা বলেন –আমার কন্যা জগৎ বিখ্যাত।
এত শুনে জন্মেজয় ধীবরবংশে ঐ সুন্দরী কন্যার জন্মের কারণ জানতে চাইলেন।
..........................................

Wednesday, March 16, 2011

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৩৪

অষ্টবসুর জন্ম–বিবরণঃ

হস্তিনানগরের রাজা শান্তনু, তার গুণে পৃথিবী পূর্ণ।
ধার্মিক, মহাধনুর্দ্ধর রাজা বনে মৃগয়া(শিকার) করতে যান।
একদিন একা ভ্রমণ করছেন গঙ্গার তীরে, হঠাৎ সেখানে দেবী গঙ্গা উপস্থিত হলেন। পদ্মের কেশরের মত বর্ণ, শ্বেতবস্ত্র পরিধানে, অপরূপ লাবণ্য-দেখে শান্তনু আশ্চর্য হলেন।
তিনি কন্যার কাছে গিয়ে তার পরিচয় জানতে চাইলেন।
তার রূপে রাজা মুগ্ধ। তিনি তাকে তার নারী হতে অনুরোধ করলেন।

কন্যা বলেন –রাজা, আমি তোমার স্ত্রী হবো, কেবল একটি নিবেদন। আমার কোন কাজে তুমি বাধা দেবে না, নিষেধও করবে না। যেদিন তুমি এর বিরোধীতা করবে, সেদিনই আমি তোমায় ত্যাগ করবো।
রাজা সকল শর্ত মেনে নিলেন। এভাবে শান্তনু ও গঙ্গার বিবাহ হল।
রাজা দিব্যরত্ন ভূষণে স্ত্রীকে সাজালেন। সর্বদা তাকে তুষিলেন। এভাবে মহাসুখে শান্তনু গঙ্গার সাথে অবস্থান করলেন।

ধিরে ধিরে অষ্টবসু শান্তনুর গৃহে পূর্ণশশীরূপে জন্ম নিতে লাগল। পুত্রের রূপ দেখে শান্তনু খুশি হলেন। নানা দান, যজ্ঞ করলেন।
এদিকে গঙ্গা পুত্র নিয়ে জলে ভাসিয়ে আসেন। দেখে শান্তনু কষ্ট পান। এভাবে এক এক করে পুত্র জন্মায় এবং গঙ্গা সকলকে ভাসিয়ে দেন। পূর্ব সত্যের ভয়ে রাজা গঙ্গাকে কিছু বলতে পারেন না। কিন্তু প্রতি মুহুর্তে তিনি পুত্রশোকে জ্বলতে থাকেন। এভাবে সাত পুত্র জন্ম নেয় এবং গঙ্গায় ভেসে যায়। পুত্রশোকে শান্তনু গুমড়ে ওঠেন। শেষে আবার তার পুত্র জন্মায়। এই অষ্টম পুত্রকে নিয়ে গঙ্গা জলে নামেন।


ক্রুদ্ধ হয়ে শান্তনু গঙ্গাকে বলেন –কে তুমি মায়াবী! কোথা থেকে এলে! তোমার মত নিন্দিতা পৃথিবীতে দেখা যায় না, যে নিজ গর্ভের সন্তানকে নিজে হত্যা করে। কিভাবে তুমি নিজের সন্তানদের হত্যা করো, হে পাষানী!
এতো বলে নিজপুত্রকে কোলে তুলে নিলেন।

গঙ্গা বলেন –রাজা, পুত্র বাঞ্ছা করলে! তুমি আর আমায় চাও না। এই পুত্রটিকে তুমি যত্ন করে পালন করো। এবার আমি তোমায় নিজ পরিচয় দেবো।
আমি জাহ্নবী। তিনলোক আমায় পূজা করে। আমার গর্ভে যে পুত্রগুলি জন্মাল তারা সব অষ্টবসু। বশিষ্টের শাপে তারা কাতর হয়ে আমায় প্রার্থনা করেন। আমি তাদের অঙ্গীকারে সম্মত হই এবং সে কারণে তোমার স্ত্রী হই।

রাজা বলেন -পূর্বের কথা বলো। কি কারণে বসুদের বশিষ্ট শাপ দিলেন।
জলাধিপতি বরুণ

গঙ্গা বলেন –বরুণের পুত্র বশিষ্ট মুনি। হিমালয় পর্বতে তার তপোবন। নানা ফলফুলে তার বন শোভিত। দক্ষ-কন্যা সুরভি তার গৃহিনী। কামধেনু তাদের কন্যা।
বশিষ্ট মুনি
একদিন অষ্টবসুরা(ভব, ধ্রুব, সোম, বিষ্ণু, অনিল, অনল, প্রত্যুষ ও প্রভব-এরা দক্ষের কন্যা বসুর পুত্র)তাদের স্ত্রীদের সাথে সেই বনে উপস্থিত হলেন। তারা মুনির তপোবনে স্ত্রীদের সাথে ভ্রমণ করছিলেন।

প্রভব বা দিব্যবসুর স্ত্রী কামধেনুকে দেখে মুগ্ধ হলেন। স্বামীকে এই গাভীটি সম্পর্কে জানতে চাইলেন।
কামধেনু

দিব্যবসু বলেন এটি মুনি বশিষ্টের গাভী। এর অনেক গুণ। এর একপলা দুধও যদি নরলোক পায় তবে তা পান করে দশ সহস্র বছর বাঁচা যায় এবং চির যৌবন প্রাপ্ত হয়।
স্বামীর কথায় স্ত্রী বলেন তার নরলোকে সখী উশীনর-কন্যা জিতবতীর জন্য তিনি কামধেনুর দুগ্ধ চান।

স্ত্রীর বশ হয়ে বসু গাভীটি নিয়ে নিজ গৃহে যান।

এ সময় বশিষ্ট আশ্রমে ফিরে এসে গাভী দেখতে না পেয়ে তাকে খুঁজতে বের হন। অনেক খুঁজেও যখন পেলেন না, তখন চিন্তিত হয়ে ধ্যানে বসে জানতে পারেন অষ্টবসুর গৃহে তার গাভী হরণ করে নিয়ে গেছে।
ক্রোধে বশিষ্ট শাপ দেন তারা মনুষ্যলোকে জন্মাবেন। বসুরা এই শাপের কথা শুনে মুনিকে স্তব করতে থাকেন।

মুনি বলেন –আমার বাক্য খন্ডন হবে না। প্রতি বছর একজন করে মুক্তি পাবে। তবে যে গাভীটি চুরি করেছে সেই দিব্যবসু পৃথিবীতে থেকে যাবে। সে ধার্মিক, সর্বশাস্ত্রবিশারদ, পিতার প্রিয়কারী এবং স্ত্রীসম্ভোগত্যাগী হবে। পরে যদিও মুক্তি পাবে।

এরপর গঙ্গা বলেন -মুনির শাপে কাতর বসুরা আমাকে স্তব করল এবং প্রার্থনা করল জন্ম মাত্র যেন তাদের ভাসিয়ে দেওয়া হয়, তবেই তারা মুক্তি পাবে। সে কারণেই আমার মর্তে তোমার স্ত্রী রূপে আগমন।

রাজা, এই পুত্র অবতার। তবে মায়ের বিহনে পুত্র দুঃখ পাবে তাই এই পুত্র আমার সাথে এখন যাবে। পুত্র সুশিক্ষিত ও যৌবনপ্রাপ্ত হলে আবার তাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে যাবো।
এত বলে গঙ্গা পুত্রকে নিয়ে অন্তর্ধান হলেন।
রাজা শান্তনু স্ত্রী ও পুত্র শোকে কাঁদতে কাঁদতে নিজ গৃহে ফিরে গেলেন।
..........................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers