Blog Archive

Saturday, March 25, 2017

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৪১

[পূর্বকথা - যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন ....... মুনিরা হোম যজ্ঞের আয়োজন শুরু করেন.......দ্রুপদ ও অন্যান্য গণ্যমান্য রাজারা আসতে লাগলেন... কৃষ্ণদর্শনে লঙ্কার রাজা বিভীষণ উপস্থিত হলেন....কৃষ্ণের শত অনুরোধেও রাজাজ্ঞা বিনা দক্ষিণ ও পূর্ব দ্বার দিয়ে তাকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হল না... ভীমের সাজাপ্রাপ্ত কিছু রাজাকে কৃষ্ণ প্রাণদান করেন....কৃষ্ণ বিভীষণকে নিয়ে উত্তর ও পশ্চিম দ্বারেও প্রবেশানুমতি পেলেন না ] 



সর্বলোক মূর্ছাঃ 

জন্মেজয় রাজা পুনরায় বৈশম্পায়ন মুনিকে তারপর কি হল জানতে চাইলেন। 

মুনি বলেন – শুনুন পরীক্ষিতের নন্দন তারপর কি হল। 
বিভীষণকে নিয়ে নারায়ণ বসলেন। পদব্রজে চলে অনেক পরিশ্রম হয়েছিল। তার উপর চারদিকে মানুষজনের ঠেলাঠেলি। চারটি দ্বার অযুত ক্রোশ দূরত্ব-ঘুরে ঘুরে দুজনেই ক্লান্ত শ্রান্ত হলেন। 

সিংহাসনে বসে তারা যখন বিশ্রাম নিচ্ছেন তখন মাদ্রীপুত্র সহদেব উপস্থিত হলেন। গোবিন্দকে দেখে তিনি প্রণাম করলেন। কৃষ্ণ তাকে ডেকে সকল সমাচার নিতে লাগলেন। 

কৃষ্ণ বলেন – দুতিনদিন রাজার সাথে দেখা সাক্ষাৎ নেই। হে সহদেব, সভার সংবাদ কি বল। 

সহদেব বলেন – হে দামোদর, আপনি যাওয়ার পর সকল অমর দেবতারা এসে রাজদর্শন করছেন। এখন সকলে আপনার অপেক্ষায় আছেন। দেবরাজ ইন্দ্র আপনার দর্শনে উদগ্রীব। 

একথা শুনে শ্রীবৎসলঞ্ছন কৃষ্ণ উঠে পরলেন। তার সাথে নিকষা নন্দন বিভীষণ চললেন। 
সভা মাঝে দেব-নারায়ণ প্রবেশ করতেই সর্বজন উঠে দাড়ালেন। 
সকলে বেদীর উপর অবস্থান করছিলেন। কৃষ্ণকে দেখা মাত্র সকলে কৃতাঞ্জলী করে কদলীর মত তার পদ প্রান্তে পরলেন-দেবতা, গন্ধর্ব, অপ্সর, কিন্নর, দেবঋষি, ব্রহ্মঋষি, রক্ষ, ক্ষগবর। 
শত সোপানের উপর ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির অবস্থান করছিলেন। 

পঞ্চশত সোপানে উঠে নারায়ণ বিশ্বরূপ প্রকাশ করলেন। সে রূপ দেখে সকলে অভিভূত। 

পদ্মাসন ব্রহ্মা মুগ্ধ নয়নে সে রূপ পান করতে থাকেন। 

দেব জনার্দন কৃষ্ণের সহস্র মস্তকে শোভে সহস্র নয়ন, সহস্র মুকুট মণি, কিরীটে সজ্জিত। 
সহস্র শ্রবণ কর্ণে শোভে সহস্র কুন্ডল। 
সহস্র নয়নে রবি সহস্রমণ্ডল। 
সহস্র করে(হাতে) শোভে বিবিধ আয়ুধ(অস্ত্র)। 
সহস্র চরণে শোভে শত শশধর(চাঁদ)। তাকে ঘিরে যেন সহস্র সহস্র সূর্যের উদয় হয়েছে। 
শ্রীবৎস কৌস্তভমণি হৃদয়ে শোভা পাচ্ছে। গলায় দোলে আজানুলম্বিত বনমালা। 
পীতাম্বর শোভে যেন মেঘেতে চপলা। 
শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম আর শার্ঙ্গ ধনুতে(বিষ্ণুর ধনুক) শোভিত নানাবর্ণ মণিময় বিভূষিত তনু। 
সহস্র সহস্র শম্ভু আছেন করজোড়ে। শত শত মুখে তারা স্তুতি-বাণী পড়ে। 

সকলে চক্ষু মুদে বুকে হাত দিয়ে প্রণিপাত(ভুমিতে লুটিয়ে প্রণাম) করেন। এভাবে হঠাৎ বিশ্বপতির বিশ্বরূপ দর্শন করে সকলে অচেতন হলেন। 
অন্তরীক্ষ থেকে বিধাতা ব্রহ্মা বিশ্বরূপ দর্শন করে নিমেষে অষ্ট আঁখি মুদলেন এবং নিজেকে পাসরে(ভুলে) করজোড়ে অজ্ঞান হয়ে ভুমিতে লোটালেন। 
শিব যোগিরূপ ধারণ করে লুকিয়ে ছিলেন। তিনিও বিশ্বরূপ দেখে লুটিয়ে পরলেন। 
ইন্দ্র, যম, কুবের, বরুণ, হুতাশন-অগ্নি, চন্দ্র, সূর্য, খগ, নাগ, গ্রহ, রাশিরা-যে যেখানে ছিলেন সকলে সেখানেই অচেতন হয়ে পরে গেলেন। 

দেব ভগবান জগন্নাথ যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকিয়ে করজোড়ে বলেন – হে মহারাজ, দেখুন পূর্বদিকে চতুর্মুখ ব্রহ্মা অষ্টভুজ যুড়ে লুটিয়ে পরেছেন। তার পিছনে প্রজাপতিরা কর্দম, কশ্যপ, দক্ষ আদি সকলে প্রণত। 
ব্রহ্মার দক্ষিণে যোগী বেশে ত্রিলোচন পঞ্চানন মহেশ প্রণাম জানাচ্ছেন। কার্তিক, গণেশ তার পিছনে আছেন। 
নিজগুণে আপনি সকলের নমস্কার পাচ্ছেন। 
দেখুন প্রণত সহস্রলোচন ইন্দ্রের সহস্র নয়নে বারিধারা বয়ে যাচ্ছে। 
দ্বাদশ আদিত্য, দেব শশধর, কুজ(মঙ্গল), বুধ, গুরু শুক্র, শনৈশ্চর(শনি), রাহু, কেতু, অগ্নি, তারা, অষ্ট বসু, মেঘ, বার, তিথি, যোগ, নক্ষত্রমণ্ডলী, দেবঋষি, ব্রহ্মঋষি, রাজঋষিরা সকলে আপনাকে প্রণাম জানাচ্ছেন। 
যাম্যভিতে(দক্ষিণদিকে) দেখুন মহারাজ মৃত্যু অধিপতি যম আপনাকে প্রণাম জানাচ্ছেন। 
পশ্চিমদিকে দেখুন জলেশ্বর বরুণদেব করজোড়ে ভুমিষ্ঠ। সিন্ধু সহ যত নদ, নদী, যত দানব, দৈত্য, অমর-বিবাদী(রাক্ষস), সহস্র মস্তক ধরে শেষ বিষধর নাগ সম্রাট তার সহস্র সোদর(সহদর) নিয়ে ভূমিতে পরে প্রণাম করছেন। 
উত্তরে দেখুন যক্ষপ্রধান প্রণত। চারশ ধবল গন্ধর্ব অশ্ব নিয়ে দেখুন চিত্ররথ প্রণাম করছেন। গন্ধর্ব, কিন্নর, যক্ষ, অপ্সর, অপ্সরী সকলে ভূমিতে লুতিয়ে আপনাকেই প্রণাম করছেন। 
এদের বামদিকে দেখুন রাক্ষস শ্রেষ্ঠ, শ্রীরামের মিত্র ও রাবণের কনিষ্ঠভাই বিভীষণ আপনাকে প্রণাম জানাচ্ছেন। 
আরো দেখুন মহারাজ, ছয় পুত্র নিয়ে খগেশ্বর গরুড়ও প্রণত। 
ভীষ্ম, দ্রোণ, জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্র, উগ্রসেন, যজ্ঞসেন, শল্য, মদ্রনাথ, বসুদেব, বাসুদেব আদি সকলে আজ আপনাইয় প্রণাম জানাচ্ছেন। 
এই পৃথিবীতে আপনার সমতুল্য রাজা আর কেউ নেই। কে আপনার গুণের বর্ণনা করতে পারে! আপনার কীর্তি ও যশে ব্রহ্মান্ড পূর্ণ হল। আপনার এই গুণে আমিও আপনার বশ হয়েছি। 

কৃষ্ণের বচন শুনে রাজা যুধিষ্ঠির ভয়ে আকুল হয়ে কাঁপতে লাগলেন। দুনয়ন দিয়ে অবিরাম বারিধারা ঝরতে থাকে। মুহুর্মুহু তিনি অচেতন হয়ে পরেন। 
অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে গদগদ হয়ে যুধিষ্ঠির বলেন –হে প্রভু! আমার মত অকিঞ্চিত জনের প্রতি আপনার একি করুণা! আপনার চরণে আমার অসংখ্য প্রণাম। 
হে ঘনশ্যাম আমার নিবেদন শুনুন। 
তড়িত জড়িত পীত কৌষবাস(রেশমিবাস) সাজে শ্রীবৎস কৌস্তভমণি তব অঙ্গ মাঝে, শ্রবণে(কানে) পরশে চক্ষু পুণ্ডরীকপাত(শ্বেতপদ্মের মত যে আঁখি কর্ণকে স্পর্শ করে)। বিষ্ণু বিশ্বরূপ প্রভু আপনিই সর্বলোকের নাথ। সংসারে যত পুণ্যাত্মা জন আছেন সকলে তারা সদা আপনার চরণ বন্দনা করেন। সকলেই আপনার চরণে বন্দি হওয়ার আশা রাখেন। তাদের সামনে আমি অতি ক্ষুদ্র, কিছু প্রার্থনার ভরসা পাই না। তবু যদি দয়া করে আমায় বর দিতে চান তবে এই নিবেদন করি-সদা যেন আপনার চরণে স্থান পাই। পৃথিবীতে সবই অনিত্য, যেন বেদের বাজি-আপনিই কেবল সত্য। আপনার মায়া, আমার কিবা শক্তি বুঝি! 

গোবিন্দ বলেন –রাজা সব ক্ষম আপনি। ভক্তিমূল্যেই আপনার কাছে বিক্রীত হয়েছি আমি। আমার নিয়মে আমার মধ্যেই ভক্তের অবস্থান। বলিকে সে কারণে আমি বড় ভক্ত মানি। আমার কাছে ব্রহ্মা, ইন্দ্রাদিও তার সমান নন। 
দেখুন দেন-দানব, রক্ষ, যক্ষ সকলে আপনার চরণে আজ প্রণাম জানাচ্ছেন। 
আমিও আজ প্রণাম জানাই ভক্তের চরণে। 
এই বলে জগন্নাথ যুধিষ্ঠিরের সামনে ভুমিষ্ঠ হয়ে লুটিয়ে রাজার অনেক স্তুতি করেন। 

এভাবে নারায়ণ নিজের মায়া বশে সবাইকে মোহিত করলেন। যারা তার এরূপ দেখল, তারাই পাসরণ(বিস্মিত) হল। 

মাতুলপুত্র অচ্যুত কৃষ্ণের এরূপ দেখে অভিভূত যুধিষ্ঠির সহদেবকে বলেন –ওনাকে বল আমার আজ্ঞা এবার দয়া করে উঠে পরুন। 

সহদেব কৃষ্ণকে বলেন –হে প্রভু নারায়ণ, দয়া করে উঠে পরুন। রাজা আজ্ঞা দিচ্ছেন। আমাদের প্রার্থনা স্বীকার করুন। 

আজ্ঞা পেয়ে গোবিন্দ মাথা তুলে উঠলেন। বুকে হাত দিয়ে কৃষ্ণ বলেন –হে রাজন, বহুদিন হয়ে গেল দেব, খগ, নাগ প্রমুখেরা এখানে অবস্থান করছেন। এবার তাদের আজ্ঞা দিন, তারা সকলে নিজেদের যজ্ঞভাগ নিয়ে নিজ নিজ স্থানে ফিরে যান। ভারতবর্ষে যত রাজারা বাস করেন সকলে বহুদিন ধরে আপনার দর্শনের জন্য দ্বারে দ্বারে অপেক্ষমান। দেবতারা বিদায় নিলে তবেই তারা রাজ দর্শনের সুযোগ পাবেন। 
নাগরাজ বিষধর শেষরাজ সাতদিন ধরে যজ্ঞস্থানে আছেন। অন্ন-জলহীন হয়ে সখা অর্জুন ধরণীর ভার সামলাচ্ছে। তার উপর বড়ই অবিচার হচ্ছে। 
একথা শুনে শেষনাগ লজ্জায় মলিন হলেন। 
ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির আজ্ঞা দিলেন সকলকে তাদের যজ্ঞভাগ দানের। 
যে যার প্রসাদ গ্রহণ করে স্ব স্ব দেশে গমন করলেন। 

কাশীরাম দাস পয়ার ছন্দে এই সকল কথা রচনা করলেন, যা শ্রবণে সকলের পাপ সংহার হয়।
......................................

Saturday, March 11, 2017

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১৪০

[পূর্বকথা - যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেন ....... মুনিরা হোম যজ্ঞের আয়োজন শুরু করেন......দেবগণকে নিমন্ত্রণ করতে অর্জ্জুন যাত্রা করেন ....দ্রুপদ ও অন্যান্য গণ্যমান্য রাজারা আসতে লাগলেন... কৃষ্ণদর্শনে লঙ্কার রাজা বিভীষণ উপস্থিত হলেন....কৃষ্ণের শত অনুরোধেও রাজাজ্ঞা বিনা দক্ষিণ ও পূর্ব দ্বার দিয়ে তাকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হল না... ভীমের সাজাপ্রাপ্ত কিছু রাজাকে কৃষ্ণ প্রাণদান করেন ] 



[সবাইকে দোলের শুভেচ্ছা :) ]

উত্তর ও পশ্চিম দ্বারে বিভীষণের অপমানঃ 

পথে যেতে যেতে কৃষ্ণ বিভীষণকে বলেন –হে বিভীষণ, আপনি তো বহু রাজা দেখেছেন, অনেকের কথা শুনেছেন। কিন্তু এমন সম্পদ কারো আছে জেনেছেন! আমাকেও যার দ্বারীরা বাঁধা দিচ্ছে! এদের প্রভুভক্তি দেখে আমি মুগ্ধ। 
ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির মহারাজের জন্য তিন ভুবনের লোক একত্র হয়েছে। ইন্দ্র আদি দেবতারা তাকে কর প্রদান করছেন। 

বিভীষণ বলেন –হে দেব, এতে অবাক হওয়ার কি আছে! এর চেয়েও বড় বড় রাজসূয় অনেক হয়েছে। মহারাজ হরিশচন্দ্র যে রাজসূয় করেন তাও বিশাল ছিল। সপ্ত দ্বীপবাসী মানুষ একত্র হয়েছিল। আরো যারা এ যজ্ঞ করেন অনেকেই ইন্দ্র আদি দেবতাদের জয় করে যজ্ঞে আমন্ত্রণ জানান। 
তবে এই পাণ্ডবদের কীর্তি কিছু বিশেষ হচ্ছে কারণ আপনি হৃষীকেশ এদের বিশেষ স্নেহ করেন। ব্রহ্মা আদি দেবতারা আপনাকে ধ্যান করেন আর এখানে আপনি দ্বারে দ্বারে ভ্রমণ করছেন দেখে আমি আশ্চর্য হচ্ছি। 
আপনার চরিত্র আমি সামান্য সেবক কি বুঝতে পারি! একদিন আপনিই বলিকে দূর করে নহুষ[একবার ইন্দ্র ব্রহ্মহত্যা অভিশাপে সমুদ্রের মধ্যে বসবাস করছিলেন। এই সময়ে রাজা নহুষকে স্বর্গের রাজা করা হয়। নহুষ ইন্দ্রের পত্নী শচীকে অধিকার করার চেষ্টা করেন।... পরে অগস্ত্যের অভিশাপে সর্প হন। অভিশাপগ্রস্থ নহুষ, অগস্ত্যের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে, অগস্ত্য বলেন,— যুধিষ্ঠিরের স্পর্শে সে শাপ মুক্ত হবে।]কে ইন্দ্রত্ব দান করেন। আমরা আপনার সামনে অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র। আপনি কাকে কি দান করেন আমাদের বোধের অগম্য। 
ইন্দ্রাদি দেবতাদের আমি দেবতা বলে মানি না। আপনার পদে যার ভক্তি সেই আমার কাছে মহান। ভক্তির দ্বারা পাণ্ডবরা আপনাকে বশ করেছে বুঝতে পারছি। সে কারণে এই দ্বারীদের আপনি ক্ষমা করছেন। 
কিন্তু কি কারণে জগন্নাথ আপনার এত ভ্রমণ! কি বা এর প্রয়োজন! দৈব বলে এই দ্বারীরা আজ আমায় পথ দিচ্ছে না, আমারও আর ভিতরে প্রবেশের প্রয়োজন নেই। আপনাকে দেখেই আমার মনোকামনা পূর্ণ হয়েছে। এবার আজ্ঞা দিন প্রভু নিজ রাজ্যে ফিরে যাই। 

বিভীষণের কথা শুনে চক্রধর কৃষ্ণ বলেন –হে লঙ্কেশ্বর আপনাকে আমি আর কি বলব। সর্বধর্ম জ্ঞানী পন্ডিত আপনি। আপনার কিন্তু একথা বলা উচিত হল না। যিনি আপনাকে নিমন্ত্রণ জানালেন তার সাথে দেখা নাকরেই ফিরে যাওয়া কি উচিত! আপনাকে এখানে সবাই আমার সাথে দেখছে। পরে যুধিষ্ঠির আমায় আপনার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে আমিই বা তাকে কি উত্তর দেব! সবাই বলবে আপনি আমার সাথেই দেখা করতে এসেছেন, এতে আমার অসম্মান। এই কি আপনি চান! আমার কথা ভেবেই না হয় একটু রাজদর্শন করে যান। 

এভাবে কথা বলতে বলতে তারা উত্তর দুয়ারে উপস্থিত হলেন। সেখানে কাম(প্রদ্যুম্ন)পুত্র অনিরুদ্ধ কৃষ্ণের পৌত্র পাহারায় ছিলেন। তিনি গোবিন্দকে দেখে প্রণাম জানালেন। 

শ্রীকৃষ্ণ বলেন – ইনি রাক্ষস ঈশ্বর বিভীষণ। ধর্মরাজের সাথে এনার সাক্ষাৎ করাতে নিয়ে যাচ্ছি। 

অনিরুদ্ধ জোড়হাতে বলেন –হে দেব, একটু অপেক্ষা করুন, এখনই মাদ্রীপুত্রেরা আসবেন। তাদের মাধ্যমে রাজাজ্ঞা নিয়ে এনাকে প্রবেশ করাবেন। 

গোবিন্দ বলেন –তুমি এনাকে চিনতে পারছ না। এনাকে একটুও অপেক্ষা করান উচিত হবে না। ইনি রাবণের সহোদর, লঙ্কার অধিপতি। এই রাক্ষসরাজ স্বয়ং ব্রহ্মার নাতি। 

একথা শুনে অনিরুদ্ধ হেসে বলেন – সব জেনেও প্রভু এমন কথা কেন বলছেন! দেখুন কত দেবতা ও রাজারা এই দ্বারে কতদিন ধরে অপেক্ষা করছেন। 
প্রাগ্‌দেশের রাজা ভগদত্ত নয় কোটি রথ, সঙ্গে কোটি মত্ত গজ ও বিশ সহস্র রাজাদের সাথে ঐরাবত সমান হাতির পিঠে নানা রত্ন নিয়ে বহুদিন দ্বারে বারিত হয়েছেন। 
বাহ্লীক, বৃহন্ত, সুদেব, কুন্তল, সিংহরাজ সুশর্মা, রোহিত, বৃহন্নল, কামদেব, কামেশ্বর রাজা কামসিন্ধু, ত্রিগর্ত, দ্বিরদর্শীর মহারাজ সিন্ধু-এদের সবার সাথে পাঁচশ রাজারা ত্রিশ কোটি মত্ত হাতি, ত্রিশ কোটি রথ নিয়ে প্রবেশ অনুমতির অপেক্ষায় আছেন। 
এই দ্বার দিয়ে বিনা অনুমতিতে বিহঙ্গেরও(পাখি) প্রবেশানুমতি নেই। দেখুন এই মহারথী রাজারা নানা রত্ন দানের উদ্দ্যেশে ধৈর্য্য ধরে কেমন দিনের পর দিন অপেক্ষা করছেন। 
ব্রহ্মার অনেক পুত্র ও পৌত্র এসেছেন তাদেরও অপেক্ষা করতে হচ্ছে। 
এছাড়াও ইন্দ্র, চন্দ্র, জলেশ, দিনকর, ব্রহ্ম ঋষি, দেব ঋষিও বিস্তর এভাবেই প্রবেশ করছেন। 
চিত্ররথ, গন্ধর্ব, তুম্বুরু, হাহা, হূহূ, বিশ্বাবসু, আরো বহু বিদ্যাধররা, যক্ষরাজ-আরো কতজনের যে নাম নিই! সবাইকেই দু-একদিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে। রাজাজ্ঞায় মাত্র দু-একজন সঙ্গে সঙ্গে প্রবেশ করতে পেরেছেন। 
এখন ভেবে দেখুব বিনা অনুমতিতে এনাকে প্রবেশ করালে আমি রাজদ্রোহী হয়ে যাব। আমাদের উপরে আছেন মহাবীর ভীমসেন। তিনি অতি ক্রোধী, কাউকে ক্ষমা করেন না। এবার আমার অবস্থা বুঝে দেখুন, দেব! কিভাবে বিনা আজ্ঞায় এনাকে আমি পথ ছারি! 

এত শুনে কৃষ্ণ পৌত্রের অনেক নিন্দা করে পশ্চিম দুয়ারের দিকে চললেন। 
দুঃখ করে গোবিন্দ বলেন –দেখলেন রাজা বিভীষণ অনিরুদ্ধ আমার পৌত্র হয়েও সম্মান রাখল না। যদিও তাকেও দোষ দিতে পারি না। ইন্দ্র, যমও ভীমের প্রতাপকে ভয় পান। রেগে গেলে ভীম অল্প দোষেও দন্ড দেবে। অন্যায় শোনা মাত্র এদের দন্ড দিতে পারে। চলুন পশ্চিম দ্বারে দুর্যোধন আছে। সে আমায় দেখে অবশ্যই আপনার জন্য পথ ছেড়ে দেবে। 
আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে, রাজন! যখনই ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিররাজার সাথে দেখা হবে তখন অবশ্যই ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম জানাবেন। নৃপতি আজ্ঞা দিলে তবেই উঠবেন। 

বিভীষণ জোড়হাতে বলেন –প্রভু, আমার কথা আমি আগেই নিবেদন করেছি। আমার সম্পূর্ণ দেহ আপনার কাছে বিক্রীত। আপনার পদ ছাড়া আর কারো কাছে এই মাথা নোয়াতে পারব না। 

এত শুনে চিন্তিত কৃষ্ণ মনে মনে ভাবেন-বিভীষণকে ডেকে দেখছি বিপদ এনেছি। সভায় সে যদি রাজাকে দণ্ডবত না করে তবে যে ধর্মপুত্রের অপমান হবে। তারপর আবার ভাবলেন-কে কি ভাববে চিন্তা করে লাভ নেই। ব্রাহ্মাদি দেবতারা আমায় ধ্যান করেন। আমি এখানে যজ্ঞেশ্বর সবাই তা জানেন। ব্রহ্মাদি অনেকেই অনেক যজ্ঞ করেছেন কিন্তু কোন যজ্ঞই এযজ্ঞের উপরে নয়। 

এসব চিন্তা করতে করতে কৃষ্ণ বিভীষণকে নিয়ে পশ্চিমদ্বারে দুর্যোধনের স্থানে উপস্থিত হলেন। দুর্যোধনের উপর সকল ভান্ডারের ভার যেমন ছিল, তেমনি পশ্চিম দ্বারটিও তার অধিকারে। এই পশ্চিম দ্বারে যেন কনক, রজত, মুক্তা, প্রবালের পাহাড় গড়ে উঠেছে। অমূল্য কীটজ বস্ত্র, লোমজ বস্ত্র, কস্তূরী, হস্তী দশনের(দাঁত) পর্বত। চারদিক থেকে অনবরত সামগ্রী এসে চলেছে, যেন আষাঢ শ্রাবণের বর্ষণ শুরু হয়েছে। 
দরিদ্র, ভিক্ষুক, দ্বিজ, ভট্ট আদি যত এসেছে সকলকে বিদুর অবিরাম দান করে চলেছেন। যতই দান হচ্ছে তার দ্বিগুণ বন্যার জলের মত সামগ্রী জড় হচ্ছে। একেকজন যে কত করে দান নিচ্ছে কেউ তার হিসেব রাখার নেই। এভাবে বহুদানে পৃথিবী অদরিদ্রা হয়ে উঠেছেন। নিরানব্বই ভাই সহ নিজের পরিবার নিয়ে দুর্যোধন পশ্চিম দুয়ারে অবস্থান করছে। 

গোবিন্দকে দেখে দুর্যোধন বলে –হে নারায়ণ, কি কারণে এখানে আসা হল বলুন। 

গোবিন্দ বলেন –ইনি লঙ্কার ঈশ্বর-বিভীষণ মহারাজ। এনাকে তোমার কিঙ্কররা ভিতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। 

দুর্যোধন বলে –তাদের কোন দোষ নেই। ভীমের আক্রোশকে সবাই ভয় পায়। হে কৃষ্ণ দেখুন, পশ্চিমদ্বারে কত রাজারা অপেক্ষায় আছেন। শিরসি দেশের রোহিত রাজা সঙ্গে আরো শত নৃপদের নিয়ে অপেক্ষায় আছেন। এদের সাথে পাঁচ কোটি হাতি, দশ কোটি রথ আছে। এদের সৈন্যরা দশ ক্রোশ পথ জুড়ে অবস্থান করছে। নানা যানে বিবিধ রত্ন নিয়ে এরা এই দ্বারে বারিত হয়ে আছে। 
মালবরাজ শিবি, পুষ্করের রাজা এদের সাথেও পাঁচশ নৃপ আছে। এক কোটি রথ ও গজ। আর কত যে অশ্ব সাথে এসেছে কে তার খোঁজ রাখে। নানাবর্ণের ধনরত্ন নিয়ে এরা দু তিন মাস ধরে এই দ্বারেই অপেক্ষা করছে। 
দ্বারপালরাজ আর বৃন্দারক রাজা, প্রতিবিন্ধ্য নরপতি অমরকন্টক-এদের সাথেও পাঁচশ রাজা এসেছে অসংখ্য গজ বাজী নিয়ে। এদের রাজ্যের চার জাতের প্রজারাও হাজির হয়েছে নানা কর নিয়ে। এরা সকলে এখনও দ্বারে অপেক্ষা করছে। 
চাঁচররাজ চিত্রসেন রাজা ত্রিশ কোটি রথ ও ত্রিশ কোটি কুঞ্জর(হাতি), নানা রত্ন নিয়ে দেখ সবার পিছনে চোরের মত দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। 
এছাড়া আপনার পিতা বসুদেবও যদুবীরদের নিয়ে অপেক্ষমান। 
মদ্রের শল্যরাজ রাজার মাতুল দুদিন দ্বারে থেকে মাদ্রীপুত্র আজ্ঞা নিয়ে এই ভিতরে নিয়ে গেছে। 
এসেই এঁনাকে ভেতরে নিয়ে যেতে চান, কিন্তু আজ্ঞা বিনা আমরা ছাড়ি কিভাবে! এখনই মাদ্রীর পুত্রেরা আসবে, একটু অপেক্ষা করুন, নারায়ণ। 

এই বলে দুর্যোধন সিংহাসন ছেড়ে কৃষ্ণকে বসার আসন দিল। দুই সিংহাসনে দুজন বসলেন। কে বুঝবে জগন্নাথের চমৎকার! অখিল ব্রহ্মান্ড যার মায়ায় মোহিত তিনি আজ অপেক্ষায়। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ধন্য যে তিনি শুভক্ষণে জন্মেছিলেন বলে আপন গুণে এই প্রভুকে বশ করেন। তিনি প্রভুকে পাওয়ার জন্য অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন, কঠোর তপস্যা শুরু করেন। এমন যজ্ঞব্রত অনেকেই করে। তবে সকলেই কিছু পেতে চায়-বৈভব, কুবেরের ধন প্রভৃতি। কিন্তু ইন্দ্রদ্যুম্ন ছিলেন সকলের উর্দ্ধে। তিনি কেবল জগন্নাথকে পাওয়ার আশায় অনেক কষ্ট সাধন করেন। তার এই প্রচেষ্টায় পৃথিবীর প্রাণীরা ধন্য হল। গোহত্যা, স্ত্রী হত্যা ইত্যাদি নারকীয় পাপ কর্ম করে যে অনুতপ্ত হয়ে কৃষ্ণকে ডাকে এবং তার দর্শন পায় সেই স্বর্গে যেতে পারে। জন্ম জন্ম কাশী ও নানা তীর্থে সেবা করে, তপ্ত ক্লেশে যজ্ঞ ব্রত করে পঞ্চ মহাপাতকী যদি শ্রীকৃষ্ণের মুখদর্শন করে তবেই পাপ শরীর আর থাকে না। এই শ্রীমুখ যে নয়নে না দেখে সংসারে বাস করে তার নরযোনি বৃথা। সেই শ্রীমুখকে এই ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজা জগন্নাথ রূপে সেবা করেন। এই জগন্নাথ মুখপদ্ম যে দর্শন করে ও জগন্নাথ নাম স্মরণ করে পৃথিবীতে তার জীবন সফল। কাশীরাম তার চরণে প্রণাম জানান।
......................................

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers