
পুরুর জরাগ্রহণ ও যযাতির যৌবন-প্রাপ্তিঃ
দেশে ফিরে রাজা সিংহাসনে বসলেন এবং জ্যৈষ্ঠপুত্র যদুকে ডেকে বললেন শুক্রশাপে জরা তাকে আক্রমণ করেছে কিন্তু যৌবনভোগে তার মন এখনও শান্ত হয় নি। যদু তার জ্যৈষ্ঠ সন্তান এবং পরম পন্ডিত। সেই তার দুঃখ দুর করতে পারে, পিতার জরাগ্রহণ করে। এভাবে যযাতি পুত্রের কাছে পুত্রের যৌবন ভিক্ষা করলেন।
পিতার বাক্য শুনে যদু বিরস বদনে বললেন –জরার মত দুঃখ সংসারে আর কিছু নেই। শরীর শক্তিহীন হয়, দেহ হয় কুৎসিত, লোকে উপহাস করে।

তাই যদু পিতার জরা নিতে প্রস্তুত নন জানান। পিতার আরো চার পুত্র আছে তাদের এই প্রস্তাব দেওয়া হোক।
একথা শুনে রাজা ক্রোধ ভরে বললেন –জ্যৈষ্ঠ পুত্র হয়ে যদু পিতার বাক্য অমান্য করলেন তাই তার বংশের কেউ কোনদিন রাজা হবে না।
যযাতি এরপর তুর্বসুকে ডেকে সব বললেন এবং সহস্র বছর পর তিনি তাকে যৌবন দান করে জরা গ্রহণ করবেন–এ অঙ্গীকারও করলেন।
তুর্বসুও জরাগ্রহণে অপারগ হলেন। যযাতি তাকেও শাপ দিলেন পিতৃবাক্য অমান্য করায় তুর্বসু নীচজাতিদের রাষ্ট্রের দন্ডধর হবেন এবং তার বংশে যত পুত্র জন্মাবে তারা সকলে মূর্খ হয়ে অভক্ষ্য ভক্ষণ করবে।

এভাবে দেবযানীর দুই পুত্র কেউই যখন পিতার জরাগ্রহণ করলেন না, তখন রাজা শর্মিষ্ঠার পুত্রদের ডাকলেন।
শর্মিষ্ঠার জৈষ্ঠ্যপুত্র দ্রুহুও পিতার জরাযন্ত্রণা সহ্য করতে পারবেন না বললেন।
একথায় যযাতি তাকেও শাপ দিলেন যে দেশে চারজাতির ভেদ নেই সেই দেশের রাজা হবে তার ঔরসে। দ্রুহু যা আশা করবে সব নৈরাশ্যে ডুববে, তার মনকামনা কখনো পূর্ণ হবে না।
তারপর রাজা অনুকে ডাকলেন এবং তার যৌবন প্রার্থনা করলেন।
অনু বললেন –রাজন, জরাসম দুঃখ জগতে আর কিছু নেই। সদা অশুদ্ধ দেহ, অনাচার, কিছু খেলে উদরে তা জীর্ণ হয় না।
তাই সেও জরাগ্রহণ করতে পারবে না। রাজা ক্রোধে বললেন পিতার বাক্য অমান্য করায় অনু জরার যে যে দোষের কথা বলেছে সব ভোগ করবে এবং তার পুত্রেরা যৌবনে সবাই মারা যাবে।
এবার রাজা যযাতি চিন্তিত হয়ে সর্ব কনিষ্ঠ পুরুকে ডেকে পাঠালেন। বললেন সেই রাজার সর্বপ্রিয় পুত্র, সেই এখন তাকে সুখি করতে পারে।

পিতার বাক্য শুনে যোড়করে পুরু বলেন পিতার বাক্য লঙ্ঘনের সাহস তার নেই। যে জন পিতৃবাক্য রক্ষা করে না সে ইহলোকে অপযশ পায় এবং নরকে গমন করে। তিনি পিতার কাছে জরা প্রার্থনা করলেন এবং তার যৌবন পিতাকে ভোগ করতে বললেন।
পুত্রের এই বাক্যে রাজা আনন্দিত হন। তার মুখ চুম্বন করে বলেন –ধর্ম পথে পুরুর বংশবৃদ্ধি হবে, তার বংশধররাই রাজা হবে।
তারপর তিনি শুক্রাচার্যকে স্মরণ করেন এবং পুরুকে জরাদান করে যৌবনপ্রাপ্ত হন।

শ্রাদ্ধাদি তর্পণের দ্বারা পিতৃপুরুষদের সন্তুষ্ট করেন।
দরিদ্র ভিক্ষুকদের দান করেন, প্রজাদের প্রতি যতার্থ সেবা করেন, অতিথি অভ্যাগতদের সেবা করেন।
তার প্রতাপে দুষ্টেরা রাজ্য ত্যাগ করে।
রাজা কামরসে কামিনীদের তুষ্ট করেন, প্রিয় ভাষণে বন্ধুবান্ধব-মন্ত্রীদের তুষ্ট রাখেন।

এভাবে যযাতি সহস্র বছর রাজত্ব করেন। এসময় তার পূর্ববাক্য স্মরণে আসে। জরা পীড়িত পুত্রকে দেখে রাজা আপনাকে ধিক্কার করেন।
ভাবেন নিজের জরার জন্য তিনি পুত্রকে দুঃখ দিলেন, ভোগে মত্ত হয়ে তিনি পুত্রের দুঃখ দেখলেন না।

এসব কথা চিন্তা করে রাজা পুত্রকে ডেকে বলেন –বহু ভোগ আমি করেছি তোমার যৌবন নিয়ে। তুমি প্রকৃতই পুত্রকর্ম করে আমায় সন্তুষ্ট করেছ। তোমার মহিমা সংসারে প্রচারিত হবে। এখন তুমি আমায় জরাদান করে যৌবন গ্রহণ করো।
রাজা তাকে ছত্রদন্ড দান করবেন কথা দিলেন।
এতকথা বলে যযাতি জরাগ্রহণ করলেন এবং পুরুকে যৌবন ফিরিয়ে দিলেন। পুরু আপন যৌবন প্রাপ্ত হলেন।
রাজা পাত্র, মিত্র, অমাত্যদের ডেকে ঘোষণা করলেন পুরুই পরবর্তি রাজা হবেন।
ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র-রাজ্যের সকলকে রাজা আমন্ত্রণ জানালেন।
পুরুর অভিষেক দেখে প্রজারা রাজাকে প্রশ্ন করলেন বিজ্ঞ রাজা জ্যৈষ্ঠ পুত্র বিদ্যমান থাকতে কনিষ্ঠকে রাজা করলেন কেন!
রাজা বলেন -যে পুত্র পিতামাতার বাক্য অমান্য করে সে কোন শাস্ত্রমতেই পুত্রের যোগ্য নয়। পুরুই কেবল আমার প্রকৃত পুত্র-অন্যরা অকারণ। পুরু পরম পন্ডিত, সেই কেবল পুত্রের কর্ম করেছে। জরা পীড়িত পিতাকে যৌবন দিয়েছে। অন্য চারপুত্র পিতার বাক্য মানেনি। পিতৃ আজ্ঞায় পুরু সহস্র বছর জরাগ্রহণ করলেন সে কারণেই সে প্রকৃত রাজ্যের উত্তরাধিকারী।

রাজা বলেন শুক্র নিজেই এই আশির্বাদ করেছেন যে পুত্র তার জরাগ্রহণ করবেন সেই হবে রাজ্যের প্রকৃত দাবিদার। প্রজারা একথায় সন্তুষ্ট হয়।

যযাতি পুত্রকে রাজনীতির শিক্ষা দান করেন।
..........................................
No comments:
Post a Comment