Blog Archive

Saturday, November 15, 2014

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৬৮


তপতী সংবরণোপাখ্যানঃ
গন্ধর্ব বলেন– আপনি জীবন দিলেন, তার পরিবর্তে আমি চাক্ষুষী বিদ্যা দিচ্ছি। আমি জানি আপনার জন্মকথা, আপনি তপতীর গর্ভে জন্ম নিয়েছেন। আপনাকে পুরুষক্রমে ভাল ভাবে জানি। দ্রোণের মত গুরুর প্রিয় শিষ্য জেনেও আপনাদের পথ রোধ করলাম রাত্রে। তারও বিশেষ কারণ ছিল। সে সময় আমি স্ত্রীদের নিয়ে ক্রীড়ায় রত ছিলাম। স্ত্রীসঙ্গ ক্রীড়াকে অবজ্ঞা করা উচিত নয়। সে কারণে ক্রুদ্ধ হয়ে আপনাদের রোধ করি। আপনারা জিতেন্দ্রিয় ধার্মিক, সে কারণে আমার বিরুদ্ধে জয়লাভ করলেন। আপনার আগ্নেয়অস্ত্র এবং চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব আমাকে দিন।

অর্জুন গন্ধর্বের প্রার্থনা অনুসারে চাক্ষুসীবিদ্যা ও অশ্ব নিলেন এবং আগ্নেয়াস্ত্র দান করে বন্ধু হলেন।
তিনি আবার প্রশ্ন করলেন– রাত্রে আমাদের এভাবে পথ আগলে আপনি কি বুঝাতে চাইলেন !

গন্ধর্ব বলেন– আপনাদের অগ্নিহোত্র(প্রত্যহ যজ্ঞকারী ব্রাহ্মণের করণীয় হোম) নেই। ব্রাহ্মণকে সঙ্গে নিয়েও চলেন না। সে জন্যেও আমি পথ রোধ করেছিলাম। হে, তাপত্য! কল্যাণপ্রাপ্তির জন্য পুরোহিত নিয়োগ করা কর্তব্য। পুরোহিত না থাকলে কোনও রাজা কেবল বীরত্ব বা আভিজাত্যের প্রভাবে রাজ্য জয় করতে পারেন না। ব্রাহ্মণকে পুরোভাগে রাখলে চিরকাল রাজ্যপালন করা যায়।

অর্জুন বলেন– আপনি আমাকে বারংবার তাপত্য বলছেন কেন! তপতী কে! আমরা তো কৌন্তেয়।

গন্ধর্ব বলেন– তবে শুনুন কেন আপনাদের তাপত্য বলে ডেকেছি। নিজেদের পূর্ববংশের কথা মন দিয়ে শুনুন।

যিনি নিজ তেজে সমস্ত আকাশ ব্যাপ্ত করে থাকেন সেই সূর্যদেবের এক কন্যা ছিলেন তপতী। ইনি সাবিত্রীর কনিষ্ঠা। রূপে, গুণে তপতী ছিলেন অতুলনীয়া। সূর্যদেব তার উপযুক্ত পাত্র খুঁজে পেলেন না। কন্যার কারণে তিনি চিন্তিত ছিলেন। সে সময় আপনাদের পূর্বতন পূর্বপুরুষ কুরুবংশীয় সংবরণ রাজা, যিনি প্রতিদিন উদয়কালে সূর্যের আরাধনা করতেন। তিনি ধার্মিক, রূপবান ও বিখ্যাত বংশের রাজা- সে জন্য সূর্য তাকেই কন্যা তপতীকে দিতে ইচ্ছে করলেন।

সূর্যদেব

একদিন সংবরণ মৃগয়া করতে গিয়ে একা একা অশ্বের পিঠে চড়ে বহু বনে বনে ভ্রমণ করলেন। পথশ্রমে ক্লান্ত অশ্বটি জলের অভাবে প্রাণ হারাল। অশ্বহীন রাজা পায়ে হেঁটে ভ্রমণ করতে লাগলেন। দিক নির্ণয় করতে পর্বতের উপর উঠলেন। সেখানে এক অপরূপা সুন্দরী কন্যাকে দেখে মুগ্ধ হলেন। কন্যার রূপের তেজে যেন পর্বত দীপ্ত হচ্ছিল। রাজা খুব খুশি হলেন। নিজেকে ভাগ্যবান ভাবলেন এমন কন্যার দর্শন পেয়ে। রাজার মনে হল এই কন্যার সমান পৃথিবীতে আর কেউ নেই। তিনি পুতুলের মত স্থির চিত্তে কন্যাকে দর্শন করতে লাগলেন।

অনেক্ষণ পর কামে পীড়িত রাজা কন্যার কাছে গিয়ে মৃদু মধুর কন্ঠে বলেন– হে মন্মথমোহিনী, এই নির্জন বনে তুমি একা কি করছো! পদ্মের মত কোমল তোমার পদ যুগল। তার উপর স্থাপিত তোমার কদলীবৃক্ষের ন্যায় সুপুষ্ট ও সুন্দর ঊরু যুগল। নিতম্ব ঘটের মত সুন্দর, কোমরটি সরু, চক্ষু দুটি ছুড়ির মত আঘাত হানে, তার উপর কামচাপা ভুরু, কামপূর্ণ অতুল যুগল স্তন। সাপের মত বাহু দুটি কোমরের পাশে সরলভাবে অবস্থিত। নিখুঁত তোমার অঙ্গ দেখে রত্নালঙ্কার পরাতে মন চায়। তুমি কে, দেবী! দেবকন্যা, অপ্সরী, নাগিনী, মানবী নাকি কিন্নরী! এই চোখে কত দেখলাম, কানে কত শুনলাম- কিন্তু এমন অপরূপার কথা কেউ জানে না। কে তুমি, কার কন্যা। দয়া করে আমাকে বল। কি কারণে এই পর্বতে একা আছো! চাতক পাখির মত আমার কান তোমার মধুর ভাষণ শুনতে আগ্রহী। আমায় কিছু বলে তৃপ্ত কর।
এভাবে রাজা নানা ভাবে কন্যাকে বিনয় দেখালেন।

কিন্তু কন্যা কিছু না বলেই অদৃশ্য হলেন। মেঘের মধ্যে যেমন বিদ্যুৎ লুকায়, কন্যাও কোথায় লুকালো! রাজা উন্মাদের মত চারদিকে কন্যাকে খুঁজতে থাকেন। তাকে দেখতে না পেয়ে রাজা অচেতন হয়ে পরে গেলেন। এভাবে রাজা সংবরণ মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন।

অন্তরীক্ষ থেকে সেই কন্যা-তপতী রাজা সংবরণের এ অবস্থা দেখে দুঃখিত হলেন। রাজার কাছে এসে বলেন– নৃপ শ্রেষ্ঠ, উঠুন! মোহগ্রস্থ হবেন না। নিজের ঘরে ফিরে যান।

সংবরণ অস্পষ্ট বাক্যে অনুনয় করে বলেন– সুন্দরী, তুমি আমাকে ভজনা কর, নয়ত আমি প্রাণ ত্যাগ করবো। তুমি প্রসন্ন হও। আমি তোমার অনুগত ভক্ত। আমার প্রতি দয়া হলে আমায় আলিঙ্গন করে আমার প্রাণ রাখ।

কন্যা বলেন– রাজা তা হয় না। আমার পিতার কাছে আমার জন্য প্রার্থনা করুন। আমার পরিচয় দিচ্ছি। আমি সূর্যকন্যা তপতী। আপনি সূর্যের আরাধনা করে তাকে প্রীত করুন। তিনি আমাকে আপনার হাতে অর্পন করলে তবেই আমায় নিজের করে পাওয়া সম্ভব।

এত বলে তপতী অদৃশ্য হলেন। সংবরন রাজা আবার মুর্ছিত হয়ে পড়ে গেলেন। অমাত্য ও অনুচরেরা অনেক খুঁজে রাজাকে দেখতে পেলেন এবং তার মাথায় পদ্মসুরভিত শীতল জল ঢালতে লাগলেন। রাজা জ্ঞান পেয়ে চতুরদিকে তপতীকে খুঁজতে লাগলেন। সৈন্যসামন্ত দেখে কিছু বললেন না। এক বৃদ্ধ মন্ত্রীকে সঙ্গে রেখে সকলকে রাজ্যে ফেরত পাঠালেন।
এরপর রাজা সূর্যের উদ্দেশ্যে কঠোর তপস্যা শুরু করলেন। এক পায়ে অধোমুখে উপবাসে সূর্যের উদ্দেশ্যে একচিত্তে তপস্যা করতে লাগলেন।
শেষে অনেক ভেবে পুরোহিত বশিষ্ঠ মুনিকে স্মরণ করলেন। বশিষ্ঠ মুনি রাজার সামনে উপস্থিত হলেন।

তিনি যোগবলে সমস্ত জেনে কিছুক্ষণ সংবরণের সঙ্গে কথা বলে উর্ধ্বে চলে গেলেন। দ্বিতীয় সূর্যের মত তার তেজ। সূর্য কৃতাঞ্জলি করে তাকে প্রণাম করলেন। কি প্রয়োজনে মুনি তার কাছে এসেছেন জানতে চাইলেন।
মুনিও সূর্যদেবকে প্রণাম করে জানালেন- আপনার তপতী নামের কন্যাকে আমি মহারাজ সংবরণের জন্য প্রার্থনা করছি। তিনি রূপে, গুণে ভুবন বিখ্যাত। তিনি আপনারও অনুগত।

সূর্যদেব খুশি হয়ে সম্মত জানিয়ে বলেন– মুনিদের মধ্যে আপনি প্রধান, ক্ষত্রিয়ের মধ্যে সংবরণ রাজ শ্রেষ্ঠ এবং কন্যাদের মধ্যে তপতীর সমান কেউ নেই। তিন স্থানের তিন শ্রেষ্ঠ!

মুনি শ্রেষ্ঠের বচন তিনি ফেলবেন না। এত বলে কন্যা তপতীকে মুনির হাতে সমর্পণ করলেন। কন্যাকে নিয়ে মুনি রাজা সংবরণের কাছে এলেন। তপতীকে দেখে রাজা তপ ত্যাগ করলেন। যোড়হাতে রাজা বশিষ্ঠ মুনির যপ করেন। ঋষি তপতী ও সংবরণের বিবাহ দেন। পরে বশিষ্ঠ মুনি নিজের আশ্রমে ফিরে যান। মুনির আজ্ঞা নিয়ে রাজা সেই মহাবনে সুখে বাস করতে লাগলেন। রাজার সাথে যে বৃদ্ধ মন্ত্রী ছিলেন তাকে রাজা রাজ্যভার দিয়ে দেশে পাঠালেন। পর্বতের উপর রাজা স্ত্রীর সাথে বারো বছর আনন্দে কাটালেন।

সেই বারো বছর রাজ্যে এক বিন্দু বৃষ্টি হল না। বৃক্ষ, শষ্য সব পুড়ে ভস্ম হল। ঘোড়া, পাখি সব মরে গেল। রাজ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। চারদিকে চুরি, ডাকাতি শুরু হল। স্থাবর, অস্থাবর ও প্রজা ক্ষয় পেতে লাগল। মানুষ শবের মত হতে লাগল। হীনশক্তি হয়ে স্থানে স্থানে পরে রইল। চারদিকে হাহাকার রব শুরু হল। প্রমাদ গুণে মানুষ দেশান্তরি হতে লাগলো।
রাজ্যের এত কষ্টের কথা রাজা কিছুই জানলেন না। বশিষ্ঠ মুনি সে সময় দেশে এসে রাজ্যভঙ্গ হচ্ছে দেখে চিন্তিত হলেন। রাজাকে আনতে তিনি পর্বতে গেলেন।

সব জেনে রাজা সংবরণের অনুতাপ হল। তপতীকে নিয়ে দেশে ফিরে এলেন। রাজ্যে ফিরে তিনি যজ্ঞ করলেন। ইন্দ্রদেব সুখি হয়ে বৃষ্টি দান করলেন। পুনরায় ভূমিতে শস্য ফললো। পূর্বের মত সংবরণ রাজ্যকে প্রাণবন্ত করে তুললেন।


এ সময় তপতী গর্ভবতী হলেন। তপতীর পুত্র হলেন শ্রষ্ঠ কুরু। কুরুর খ্যাতি অবিসংবাদিত(সর্বসম্মত)। সে জন্যই তার কুলের নাম হল কুরুবংশ।
পুরোহিত বশিষ্ঠ মুনির সাহায্যেই রাজা সংবরণ ধর্ম, অর্থ, কাম পেলেন।
হে অর্জুন, এই তপতীর গর্ভজাত কুরুর বংশধর হলেন আপনারা পাঁচভাই। সে কারণে আমি আপনাদের তাপত্য সম্বোধন করেছিলাম।

বংশের পূর্বকথা শুনে অর্জুন হরষিত হলেন। তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন– রাজা সংবরণকে রক্ষা করলেন যে শ্রেষ্ঠ পুরোহিত বশিষ্ঠ মুনি, তার সম্পর্কে কিছু বলুন।

গন্ধর্ব বলেন- বশিষ্ঠ মুনি বিখ্যাত তার তপস্যার জন্য। তার গুণ, কাজ বর্ণনাতিত। তিনি কাম ও ক্রোধকে জয় করতে পেরেছিলেন। বিশ্বামিত্র বহুবার তাকে বিরক্ত করলেও বশিষ্ঠ তাকে কিছু বলেননি। ইক্ষ্বাকু(বৈবস্বত মনুর পুত্র, সূর্যবংশীয় প্রথম রাজা) বংশের রাজা এঁনার বুদ্ধিবলেই নিষ্কন্টক বৈভব ভোগ করেন ভূমন্ডলে।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।
....................................

No comments:

Post a Comment

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers