Blog Archive

Sunday, February 22, 2015

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৭৯

[পূর্বকথা - দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে রাজারাকেউই লক্ষ্যভেদে সক্ষম হল না...রাজারা ক্রুদ্ধ হল...শ্রীকৃষ্ণ বলরামকে বলেন এক মাত্র অর্জুনই এ লক্ষ্য ভেদ করবেন...দ্রৌপদীর ভাই ধৃষ্টদ্যুম্ন ক্ষত্রিয়দের বারবার লক্ষ্যভেদের জন্য অনুরোধ জানাতে লাগলেন...শেষে অর্জুন যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞায় লক্ষ্য ভেদ করতে উঠলেন...

অর্জুনের লক্ষ্যভেদে গমনঃ 

 

রাজারা যখন পরস্পর আলোচনায় ব্যস্ত সে সময় কুন্তীপুত্র অর্জুন ধনুকের কাছে যান। প্রথমেই তিনি তিনবার ধনুকটিকে প্রদক্ষিণ করেন। বরদাতা মহাদেবকে প্রণাম জানালেন। বাম হাতে অনায়াসে ধনুক তুলে নিলেন। কর্ণের পরান গুণ খুলে ফেললেন। পুনরায় গুণ পরিয়ে ধনুকে টঙ্কার দিলেন। সেই শব্দে সকলের কানে তালা লেগে গেল। 

মনে মনে তিনি গুরুকে প্রণাম করতে চাইলেন। কিন্তু এই অজ্ঞাতবাসকালে ছদ্মবেশে কিভাবে তা সম্ভব! 
গুরু দ্রোণাচার্য এক সময় বলেছিলেন –আমাকে যদি প্রণাম করতে চাও তাহলে প্রথমে এক অস্ত্র মেরে সম্বোধন করবে। অন্য অস্ত্র মেরে পায়ে প্রণাম জানাবে। সে কথা মনে করে পার্থ চিন্তা করলেন এবং দুটি তীর ছুঁড়লেন। বরুণ অস্ত্রে গুরুর চরণ ধৌত করলেন। অন্যটি গুরুর চরণের সামনে এসে তাঁকে প্রণাম জানালেন। 

দ্রোণাচার্য আশ্চর্য হয়ে আশীর্বাদ জানালেন। 
দ্রোণ বিস্মিত হয়ে চিন্তিত হন –এই আমার প্রিয় শিষ্য অর্জুন হবে। 
কুরুশ্রেষ্ঠ পিতামহ গঙ্গাপুত্র ভীষ্মকেও অর্জুন নমস্কার জানালেন। 

দ্রোণ তখন ভীষ্মকে বলেন -শান্তনুপুত্র! দেখুন যে ব্রাহ্মণ লক্ষ্যভেদ করতে উঠেছেন, তিনি আপনাকে প্রণাম জানাচ্ছেন। 

ভীষ্ম বলেন –আমি ক্ষত্রিয়, উনি ব্রাহ্মণ হয়ে আমাকে কি কারণে প্রণাম জানাচ্ছেন! 

দ্রোণ বলেন -ইনি কখনই ব্রাহ্মণ হতে পারেন না। ক্ষত্রিয়কুলশ্রেষ্ঠ কেউ এমন ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ নিয়েছেন। যে বিদ্যা এখনি আমাদের সামনে ইনি দেখালেন এ কেবল আমার প্রিয় শিষ্যের পক্ষেই সম্ভব। বড় বড় রাজারাও যা জানেন না, তা ভিক্ষু ব্রাহ্মণ শিখবে কি ভাবে। বিশেষ করে ইনি আপনাকে যে ভাবে প্রণাম জানাচ্ছেন তাতে বোঝা যায় ইনি আপনার বংশেই জন্মেছেন।এখনি এ ছদ্মবেশ মুছে যাবে, কতক্ষণ জ্বলন্ত আগুনকে লুকিয়ে রাখা যায়! 

ভীষ্ম বলেন –তাই তো! আমিও তাই ভাবছি, একে যেন কোথায় দেখেছি মনে হচ্ছে। ওর সুন্দর চন্দ্রমুখ দেখে আমার যে অন্তরে কি দুঃখ জন্মাচ্ছে বলে বুঝাতে পারব না। বলুন গুরুদেব আপনি এর সম্পর্কে আর কি কি জানেন। কার পুত্র, কি এঁনার নাম! 

দ্রোণাচার্য বলেন –আমি এখনি এঁনার পরিচয় প্রকাশ করতে পারি। তবে স্বপক্ষ ও বিপক্ষ দেখে মনে ভয় হয়। বিশেষ করে যে অনেকদিন মৃত বলে সবাই জানে, তাঁর নাম নেওয়া ঠিক হবে কিনা ভাবছি। 

ভীষ্ম আকুল হয়ে প্রশ্ন করেন –গুরুদেব বলুন কি ভয় পাচ্ছেন! কে মারা গেছে! কার কথা ভাবছেন! 

দ্রোণ বলেন –যে বিদ্যা ইনি দেখালেন, এ আমার প্রিয় পার্থ ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। অনেকদিন আগে আমি অর্জুনকে বলেছিলাম তোমার মত আর কাউকে আমি শিষ্য করব না। সে কারণেই এই বিদ্যা কেবল তোমাকেই দিচ্ছি। আমাকে একদিন আমার গুরু ভৃগুপুত্র পরশুরাম যা শিখিয়েছিলেন নিজপুত্র অশ্বত্থামাকেও তা না শিখিয়ে তোমাকে শেখালাম। আজ তাই ইনি দেখালেন, তাই আমার মন বলছে ইনি অর্জুন ছাড়া আর কেউ হতে পারেন না। 

পার্থ অর্জুনের নাম শুনে পিতামহ ভীষ্ম শোকাকুল হলেন। দুই চক্ষু দিয়ে অঝরে জল ঝরতে লাগল। 
তিনি আকুল হয়ে বললেন –কি বললেন আচার্য! একি কাজ করলেন! নিভন্ত অগ্নিকে জ্বালিয়ে আমার অন্তরকে আবার দগ্ধ করছেন! বারো বছর হয়ে গেল তাদের কথা শুনলাম না, দেখতেও পেলাম না। সেই সাধু পুত্রদের আর কোথায় পাবো! 
এই বলে ভীষ্ম ক্রন্দন করতে লাগলেন। 

দ্রোণ বলেন –ভীষ্ম, শোক ত্যাগ করুন। নিশ্চিন্ত ভাবে জানুন ইনিই কুন্তীর পুত্র। দেবতার সাহায্যে পঞ্চপান্ডবের জন্ম। সকলে বলে তারা মৃত কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস তারা জীবিত আছেন। বিদুরের মন্ত্রণায় তারা অবশ্যই বেঁচে গেছে- একথা আমি দিনরাত ভাবি। মুনিদের এমন উক্তিও শোনা যায় এই পৃথিবীর ভূমিতে পান্ডবদের মরণ নেই। 

এই কথা শুনে বীর ভীষ্ম ক্রন্দন ত্যাগ করলেন এবং দুজনেই আনন্দমনে আশীর্বাদ জানালেন -যদি এই কুন্তীপুত্র ফাল্গুনি(অর্জুন) হন তবে ইনিই লক্ষ্যভেদ করে দ্রুপদ নন্দিনীকে গ্রহণ করুন। 

এরপর পার্থ যোড়হাতে কৃষ্ণকে প্রণাম জানালেন। এঁনার হাতেই তাঁর জন্য পাঞ্চজন্য শঙ্খবাদ্য বেজে উঠেছে। দেখে কৃষ্ণ হেসে তাকে শুভেচ্ছা জানালেন। 
হেসে কৃষ্ণ বলরামকে বলেন – দেখুন হে, রেবতীর স্বামী! আপনাকেও ইন্দ্রের পুত্র পার্থ প্রণাম জানাচ্ছেন। আশীর্বাদ করুন পার্থ যেন লক্ষ্যভেদে সক্ষম হন। 
শুনে বলরামের হৃদয় চঞ্চল হল। তিনি বলেন –অর্জুন লক্ষ্যভেদে সক্ষম হবেন। কিন্তু কন্যা নিয়ে যাওয়ার সাধ্য হবে না। একা ধনঞ্জয়ের এত শত্রু! এক লক্ষ রাজারা সসৈন্য এসেছেন। অনুপমরূপা কৃষ্ণা মদনমোহিনী, তিনি সবার মন হরণ করেছেন। সে জন্য সবাই প্রাণপণ চেষ্টা করবে। কন্যাকে নিয়ে যুদ্ধ আসন্ন। বিশেষত পার্থকে সকলে ব্রাহ্মণ বলেই জানছেন। এতজনকে একা পার্থ অর্জুন কি ভাবে পরাজিত করবেন! 

কৃষ্ণ বলেন –দুষ্টরা অন্যায় করবে আর আমরা বসে কি তা দেখবো! আমার সামনে যদি এমন বলপ্রয়োগ করে তবে আমার জগন্নাথ নাম মিথ্যে। জগতে সৎ ব্যক্তির অন্তে আমি হই ত্রাতা, দুর্বলের বল ও সর্ব ফলদাতা। আমিই যদি উপযুক্ত ফলপ্রদান না করি তবে জগন্নাথ নাম ধারণ করব কেন! সুদর্শনচক্রে সকল দুষ্টমতিকে বিনষ্ট করব। পূর্বেও পরশুরাম পৃথিবীকে ক্ষত্রিয় শূণ্য করেছিলেন। আমিও প্রয়োজনে পৃথিবীর ভার লাঘব করব। সে জন্যেই পৃথিবীতে আমার জন্ম। 

গোবিন্দের কথায় বলরাম মনে মনে চিন্তিত হলেন। কৃষ্ণের অনুরোধে তিনি অর্জুনকে আশীর্বাদ করলেন। 

মহাভারতের কথা অমৃত লহরী, কাশীরাম দাস কহেন যা শুনলে সব পাপে পার হয় মানব-মানবী। 
................................... 

No comments:

Post a Comment

Run To You - Live at Slane Castle, Ireland.mp3

Followers